প্রচ্ছদ » বিশেষ সংবাদ » বিস্তারিত

সাত শতাংশ সুদ ও কিছু কথা

২০১৯ মার্চ ৩০ ১৬:০১:২১
সাত শতাংশ সুদ ও কিছু কথা

হাসান কবীর

দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় একটা সুখকর সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। "আগামী মে মাসের ১ তারিখ থেকে সিঙ্গেল ডিজিট (৭%) সুদহার বাস্তবায়ন হতে চলেছে।"

কথাগুলো হেলা-ফেলা গোচের কেউ বলেন নি। বলেছেন, আমাদের সুযোগ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি সম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থসচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান ও বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব কথা জানান।

আমরা তাকে কপালে হাত তুলে আর্মি স্টাইলে স্যালুট জানাই ।তবে এটা আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের নিকট একেবারে সহজ হবে না। নিঃসন্দেহে একটা চ্যালেঞ্জ আকারে ধরা দেবে । কারণ, ব্যাংকের মালিকগণ ব্যাংকটাকে বৃহৎ আকারের টাকার মেশিন বলে বিবেচনা করেন। এ ব্যাপারে ছোট-বড় কারোরই মতভেদ নেই। প্রতি বছর ব্যাংকের মুনাফার প্রবৃদ্ধি শত থেকে হাজার কোটি টাকা না হলে মালিকপক্ষের মনটা বেজায় বেজার হয়। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ মিটিংয়ে তারা চেয়ার ঘুরিয়ে বসেন। ভীষণ অভিমান করেন। তাঁদের অভিমান ভাঙতে হাজার রকমের টার্গেট নিতে হয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের। তবে এই টার্গেট অনেক সময় তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক-ঠাক টার্গেট পূরণ করতে না পারলে মালিকপক্ষ পারলে অধীনস্থদের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেন।

মালিকপক্ষ একজন আরেকজনের দিকে প্রতিযোগীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। যে ব্যাংকের প্রফিট-প্রবৃদ্ধি ভালো তার কাছ থেকে বিভিন্ন পলিসি গ্রহণের জন্য আড়ি পেতে থাকেন। কিছু পলিসি অন্য ব্যাংক থেকে গ্রহণ করেন, আবার কিছু নিজেরা আবিস্কার করেন। এসব পলিসি কর্মকর্তাদের কাঁধে তুলে দেন। কর্মকর্তারা অধীনস্থদের কাঁধে চড়ে সপাং সপাং পলিসির চাবুক চালাতে থাকে। অধীনস্থ অসহায় কর্মচারীরা রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলে টার্গেট আকারে পলিসিগুলো পূরণ করতে। কিন্তু মূল কথা হলো এই, পলিসি আবিষ্কার আর প্রয়োগ করতে করতে আজ এমন অবস্থায় পরিণত হয়েছে যে, হকার আর ব্যাংকার এর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। অন্তত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরা, হাতে পায়ে ধরার দিক দিয়ে। আগেকার দিনে ব্যাংকার দেখলে লোকে সালাম দিত। আগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিত। আর এখন পাশে বসিয়ে রাখে, কথা বলার সময় হয়ে ওঠে না। অনেকক্ষণ বসিয়ে বলে, পরে আসুন, একটু ব্যস্ত আছি।

ব্যাংক কর্মকর্তারাও যে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তারাও সুযোগ খোঁজেন, তাদের টার্গেট চাপে কুঁজো হওয়া পিঠ বাঁচানোর। কর্মকর্তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ তাদের প্রফিট প্রবৃদ্ধির হার ২ গুণ ৩ গুন বাড়াতে হবে। প্রফিট প্রবৃদ্ধির বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকারী পদ্ধতি হচ্ছে ঋণ অবলোপন। মন্দ ঋণকে কাগজ-কলমে ভাল ঋণে পরিণত করা। সাধু-অসাধু সব ধরনের কর্মকর্তারা তাদের পারফরম্যান্স ধরে রাখা বা চাকরি বাঁচানোর তাগিদে এ পদ্ধতি গ্রহণে অনেকটা বাধ্য হয়।

সুদের হার ৭% ব্যাংকিং কর্মকর্তাদের জন্য বুকের উপর আরেক খণ্ড পাথর চাপার মত। ভারী পাথরটা আরো ভারী হবে নিম্নোক্ত কারণে-
১. ব্যাংকিং বিভিন্ন সূচক বিবেচনায় ডিপোজিট এবং ইনভেস্টমেন্ট (অ্যাডভান্স) এর পার্থক্য ৫% কে অনেক ব্যাংকে আদর্শ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে ৭% যদি ইন্টারেস্ট (বিনিয়োগ প্রফিট) মার্জিন হয় তাহলে ডিপোজিটরদের প্রদত্ত সুদ (প্রফিট) হয় ২% মাত্র। এ প্রফিট মার্জিনে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, উত্তম-অধম কোনরকমের ডিপোজিটর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এমন অবস্থায় ব্যাংক তাদের ডিপোজিট হারাবে স্রোতের গতিতে।

২. ৭% সুদের হার শুধুমাত্র ব্যাংকিং সেক্টরের কথাই বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ঋণ দিয়ে থাকে। ডিপোজিট কালেকশন করে থাকে। তাদের ডিপোজিট এর চমকপ্রদ সুদের হার। ১০% থেকে ১৬% পর্যন্ত। ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টরে নিতান্তই অবলা ছাড়া অন্য কেউ ডিপোজিট রাখতে সম্মত হবে না।

৩. ব্যাংকিং সুদের হার কমানোর কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমছে না। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বিভিন্নতার মেয়াদে বর্তমানে ১২% থেকে ১৪%। অনেক সচেতন ডিপোজিটরা ব্যাংকের পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ব্যাংক তাদের কাঙ্ক্ষিত ডিপোজিট হারিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

আমাদের অর্থমন্ত্রী বিজ্ঞ মানুষ ও অভিজ্ঞ অর্থনীতীবীদও বটে। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক দুটি পর্যায়ে তার অগাধ জ্ঞান। সামষ্টিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি পর্যায়ে সুদের হার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুদের হার কম হলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। এটা সর্বজন গৃহীত। ফলে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে নিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। অর্থাৎ দেশের বেকারত্ব কমবে। দেশের লোকের আয় বাড়বে। সর্বোপরি দেশের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। দেশের উন্নয়নের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হবে। মাননীয় সুযোগ্য অর্থমন্ত্রী পাশাপাশি আমাদেরও এটাই কাম্য।

তবে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তহবিল থাকা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত তহবিল না হলে উপরোক্ত স্বপ্নগুলো একেবারে স্বপ্নই রয়ে যাবে। আর এই বিনিয়োগ তহবিল দু'ভাবে গঠিত হতে পারে-

ক. সরকারি তহবিল।
খ. বেসরকারি তহবিল।

আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে সরকারি উদ্বৃত্ত তহবিল তেমন একটা নেই বললেই চলে। উপরন্ত বেসরকারি তহবিল থেকে সরকারকে অনেক সময় ঋণ নিতে দেখা যায়।

এবার আসা যাক বেসরকারি তহবিলে। বেসরকারি তহবিল মানে বেসরকারি ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংক গুলো যদি তাদের কাঙ্খিত ডিপোজিট সংগ্রহ করতে না পারে তবে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না। এমত অবস্থায় বিনিয়োগ চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ব্যাংকের নিকট থাকবে না। কোন কোন ব্যাংক বিনিয়োগের চাপে আদর্শ আইডিআর রাখতে অসমর্থ হবে না। ব্যাংকিং সেক্টরে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করবে।

বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী ৭% ঋণ এর ক্ষেত্রে এখানে একটি কথা জুড়ে দিয়েছেন "শুধুমাত্র ভালো ঋণ গ্রহীতারা এ সুবিধা পাবেন। অসাধুরা পাবেন না।"তবে আমরাও আশাবাদী। সাধু অসাধুর সংজ্ঞা স্পষ্ট হলে অর্থনৈতিক কল্যাণ এর মাত্রা পরিমাপ করা যাবে। দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান হবে। আমরা চলব উন্নততর আয়ের দিকে।

লেখক: প্রাবন্ধিক,ব্যাংকার