প্রচ্ছদ » ধর্ম » বিস্তারিত

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-১

২০১৯ এপ্রিল ০৫ ১২:৫১:১৯
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-১

এস কে জামান

আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের এই বিশ্বে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সমাজ ও রাষ্ট্র বিধ্বংসী এই অপশক্তির ভয়াল থাবা আজ বিশ্বকে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ফেলেছে । ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে একদল চরম্পন্থী নির্বিচারে মানুষ হত্যা, রক্তা-রক্তি ও দাঙ্গা হাঙ্গামা করে যেমন গোটাবিশ্বকে অশান্ত করে তুলছে তেমনি ইসলামের শান্তিকামী চেহারা ও সৌন্দর্য ধ্বংস করতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে । এটি আজ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার শ্বাসনালীতে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যা মরণব্যাধি রূপে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে । পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন ও স্বার্থান্ধতা থেকে জন্ম নেয়া এক বিকৃত মানসিকতার শেষ পরিনতি সর্বসংহারী সন্ত্রাস যা বিশ্ব বিবেক কে আজ সাংঘাতিক ভাবিয়ে তুলেছে । অফুরন্ত শান্তি আর মানবতার কল্যাণের দিশারী ইসলামের নামে চরমপন্থা ও সত্রাসবাদ সৃষ্টি করে একে বিকৃত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে । অথচ ইসলাম হত্যা রক্তপাত সহিংসতাকে শুধু ঘৃণা করেনি বরং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে ।

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ

চরমপন্থা মানে হলো কোন বস্তুর অংশ বিশেষ ছিনিয়ে নেয়া । এই শব্দটি ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষা হিসাবে কখনো ব্যবহার হয়নি । চরম্পন্থার কোন বিশেষ সংজ্ঞা দেয়া হয়নি তবে এটুকু বলা যায় যে, কোন বিষয়ে অতি বাড়াবাড়ি করা । আর এই বাড়াবাড়ির ব্যপারে পবিত্র কোরআনে সুরা মায়েদায় ৭৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে – ‘হে আহলে কিতাবগণ তোমরা স্বীয় ধর্মে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করো না’।
চরম্পন্থার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে অন্ধতা । চরম্পন্থী বা গোঁড়া ব্যক্তি নিজের মতের প্রতি একগুঁয়ে ও অটল থাকে, কোন যুক্তিই তাকে টলাতে পারে না । অন্য মানুষের স্বার্থ ও মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে নিজের প্রবৃত্তি অনুসরণেই মত্ত হয়ে যে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করে না । এমনকি কোন হত্যাকাণ্ডের মতো মারাত্মক অপরাধের পথও বেছে নিতে পারে ।


"দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে হাগানা, ইরগুন ও স্টান গ্যাংয়ের মতো ইহুদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো আরব দেশগুলিতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় । ফিলিস্তিনের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ও এসব ইহুদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদী বলেই অভিহিত করেন । পরবর্তীতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এসব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বহু নেতাই রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । এদের মধ্যে মোশে দায়ান, আইজ্যাক রবিন, সেনচেম বেগিন ও এরিয়েল শ্যারন । আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস এসব ইহুদী সন্ত্রাসবাদী নেতারাই স্বাধীনতাকামী আরবদেরকে বিশ্ব দরবারে সন্ত্রাসী বলে চিহিত করে ।...


সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা 'ত্রাস' থেকে এসেছে । যার অর্থ-অতিশয় ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ । কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করার প্রয়াস, ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করা হলো সন্ত্রাস । এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Terror আর সন্ত্রাসবাদের ইংরেজি হলো Terrorism. আধুনিক আরবি ভাষায় সন্ত্রাস শব্দের প্রতিশব্দ হলো 'ইরহাব' যা 'রাহবুন' থেকে এসেছে যার অর্থ ভয়, ভীতিপ্রদর্শন, আতঙ্কিতকরণ । পবিত্র কোরআনে সন্ত্রাসকে দুটি শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে তা হলো ফিত্‌না-ফাসাদ । যার সরল বাংলা হলো সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি ।

যুগে যুগে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

মানবজাতির ইতিহাসে চরমপন্থী সন্ত্রাসী দলের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদী উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আশ্রয় নিয়েছেন । খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দি ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত এ সকল ইহুদী নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা রক্ষায় ছিল আপসহীন ।
তারা এতখানি চরমপন্থী ছিল যে, যেসকল ইহুদী রোমানদের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের মাধ্যমে মিলে মিশে থাকতে চাইতো তাদেরকে এরা গুপ্ত হত্যা করত । এরা এতটাই চরমপন্থী ছিল যে প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দেয়ার চাইতে আত্মহত্যাই শ্রেয় বলে মনে করত । তাদেরই উত্তসুরি ইহুদিজাতি কিভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডকে অন্যায় ভাবে দখল করে কয়েক যুগব্যাপী পাখি শিকারের ন্যায় নিরীহ নিরপরাধ শিশুসহ সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করছে তা বিশ্ববাসী তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখছে ।

মধ্যযুগীয় পপ-সম্রাটের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাস অরাজনৈতিক ও অন্ধকার যুগ বলে খ্যাত । এ সময়ে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টানদের অগণিত যুদ্ধ ও যুদ্ধবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য ঘটনা ঘটে । রাজনীতি, ক্ষমতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পোঁছেছিল যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় মনোনিবেশকারী প্রায় ৩৫ হাজার জ্ঞান পিপাসুকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার যে জঘন্য ইতিহাস তা বিশ্ববাসী আজ ও ভুলতে পারেনি ।

ইতিহাস থেকে আমরা ১৯৬০ এর দশকে আরো একটি চরমপন্থী আন্দোলনের কথা জানতে পারি । ইতালির রেড ব্রিগেড এবং জার্মানির রেড আর্মি ছিল সে সময়কার সবথেকে নামকরা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন । এ সময় ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসবাদের কথা সকলেরই জানা ।

শীতল যুদ্ধের সময়কার কথিত পরাশক্তি সোভিয়েত কমিউনিস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে ইসলামী চরম্পন্থার জন্ম দেয়া হয় । তার ফলে বিশ্ব আজ সত্যিকার অর্থে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে । একশ্রেণীর প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানহীন ধর্ম ব্যবসায়ী ধর্মের অপব্যাখ্যা করে কালজয়ী চিরঞ্জীব ইসলাম ধর্মকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে সারাবিশ্ব জুড়ে অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছে । ইরাক, লিবিয়া, ও সিরিয়ায় ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন আই এস এর উত্থানের পর মার্কিন সোভিয়েত জোটের অপারেশান ইনহারেন্ট রিজল্ভড ২০১৪ সালে ৮ আগস্ট শুরু হওয়া অভিযান এখনো চলছে ।


"মধ্যযুগীয় পপ-সম্রাটের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাস অরাজনৈতিক ও অন্ধকার যুগ বলে খ্যাত । এ সময়ে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টানদের অগণিত যুদ্ধ ও যুদ্ধবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য ঘটনা ঘটে । রাজনীতি, ক্ষমতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পোঁছেছিল যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় মনোনিবেশকারী প্রায় ৩৫ হাজার জ্ঞান পিপাসুকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার যে জঘন্য ইতিহাস তা বিশ্ববাসী আজ ও ভুলতে পারেনি ।..."


সন্ত্রসবাদ নতুন কিছু নয় । ১৮৮১ সালে সন্ত্রসীদের হাতে খুন হন রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ও তার ২১ জন সঙ্গী । ১৯০১ সালে সন্ত্রাসীরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ম্যাককিনলে ও ইতালীর রাজা প্রথম হামবার্ডকে হত্যা করে । অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চ ডি উক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ড সস্ত্রীক সন্ত্রাসিদের হাতে খুন হওয়ার কারণেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয় । এই সকল হত্যাকাণ্ড যদিও মুসলমানরা করেনি তথাপিও এগুলোকে সন্ত্রাসবাদ বলা হয় ।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে হাগানা, ইরগুন ও স্টান গ্যাংয়ের মতো ইহুদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো আরব দেশগুলিতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় । ফিলিস্তিনের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ও এসব ইহুদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদী বলেই অভিহিত করেন । পরবর্তীতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এসব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বহু নেতাই রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । এদের মধ্যে মোশে দায়ান, আইজ্যাক রবিন, সেনচেম বেগিন ও এরিয়েল শ্যারন । আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস এসব ইহুদী সন্ত্রাসবাদী নেতারাই স্বাধীনতাকামী আরবদেরকে বিশ্ব দরবারে সন্ত্রাসী বলে চিহিত করে ।

১৯৬৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জার্মানির বাদে-মেইনহুফ গ্যাং শত শত মানুষকে হত্যা করে । ১৯৯৫ সালের দিকে জাপানের রেড আর্মি ও উসশিনরিকির জন্ম হয় যারা টোকিওর পাতাল রেলে হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে । এভাবে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই সন্ত্রাসী অপতৎপরতা চলতে থাকে।

উগান্ডার 'লর্ডস স্যালভেশন আর্মি' পুরো আফ্রিকা মহাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে । শ্রীলংকার তামিল টাইগাররা বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বলে পরিচিতি লাভ করে । ভারতের আসামের উলফাদের প্রধান লক্ষ্য মুসলমান নির্মূল করা । ভারত পারমাণবিক শক্তিধর বৃহৎ রাষ্ট্র হলেও এদেশের ৬০০ জেলার ২৮০ জেলায় মাওবাদী সেকুলার সন্ত্রাসীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে । গোটা বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান, ইহুদী, হিন্দু, শিখ এমনকি বৌদ্ধদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী অসংখ্য গোষ্ঠী রয়েছে । অপরদিকে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার নামধারি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী গণহত্যা সংগঠিত হয় । ব্রিটেনে মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশী মানুষ হত্যা করেছে ক্যাথলিক আই আর এ । লন্ডন ও মাদ্রিদের পাতাল রেলে হামলার স্মৃতি ইউরোপীয়রা কোন দিন ও ভুলতে পারবে না । (ক্রমশ)

লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ০৫,২০১৯)