প্রচ্ছদ » » বিস্তারিত
পাঠক তৈরির কারিগর কাজী আনোয়ার হোসেন
২০১৭ এপ্রিল ১০ ১১:৪৮:১৮রুদ্র সাইফুল
বাজারি পসরার ভিড়ে আমরা ভুলে যাই আমাদের অস্তিত্ব, আমরা ভুলে যাই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র পাঠক তৈরির কারিগর কাজী আনোয়ার হোসেনকে। আসুন একনজরে আমরা জেনে নিই বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরির একমাত্র কারিগর কাজী আনোয়ার হোসেনকে।
লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং জনপ্রিয় ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসেবে তিনি ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে ‘কুয়াশা’ নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিল। কুয়াশা চরিত্রটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৭৬টির মতো থ্রিলার রচনা করেছেন। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে ‘বিদ্যুৎ মিত্র’ ও ‘শামসুদ্দীন নওয়াব’ নাম ব্যবহার করতেন।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দীন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। তারা ছিলেন চার ভাই ও সাত বোন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিণ কোণে যে দুটি দোতলা গেস্ট হাউস আজও দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাড়ি বদল করে তারা দক্ষিণ দিকের গেস্ট হাউসে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কিছু অংশ দক্ষিণ দিকে ছিল। কাজী মোতাহার হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে অবশ্য তারা বাসা বদল করে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাড়িতে চলে আসেন।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও বাড়িতে গানের চর্চা সব সময় ছিল। তার তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আর সনজীদা খাতুন তো সঙ্গীত শিক্ষালয় হিসেবে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ১৯৬২ সালে কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন তিনি। রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাক কাজী আনোয়ার হোসেন ছেড়ে দেন ১৯৬৭ সালে।
১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেওয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেস ব্যবসার যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকি টাকা দিয়ে টাইপপত্র। দুজন কর্মচারী নিয়ে ‘সেগুনবাগান প্রেস’-এর শুরু, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় ‘সেবা প্রকাশনী’। পরবর্তীতে তার প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের একমাত্র পাঠক তৈরির কারিগর বনে যান কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হলো ‘কুয়াশা-১’, যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
তার অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। তার মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি প্রধানত সম্পাদকের কাজ করেন।
‘মাসুদ রানা’ তার সৃষ্টি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। ১৯৬৬ সালে ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রচ্ছদ নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী হতে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে চার শতাধিক গুপ্তচর কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজের প্রথম দুটি বই ‘ধ্বংস পাহাড়’, ‘ভারতনাট্যম’ এবং ‘হ্যাকার’ ছাড়া বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাসুদ রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের (Ian Fleming) সৃষ্ট জেমস বন্ড (James Bond) চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মাঝে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সালের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের পরামর্শে রহস্যপত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এবং পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থগিত রাখা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর ১৯৮৪ সালে রহস্য পত্রিকা আবার প্রকাশিত হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।
১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় (মূল ভূমিকায় ছিলেন মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা)। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’র কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের ‘পিশাচ দ্বীপ’ নামক বই থেকে। ১৯৯৪ সালে আতিকুল হকের নির্দেশনায় প্রচারিত হয় নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’।
কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম সমালোচনা ছিল তিনি মাসুদ রানা সিরিজে যৌনতার বেসাতি পেতেছেন। এই হাওয়ায় পাল এতটাই উঠেছিল যে, ‘প্রজাপতি’ মার্কাওয়ালা বই পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বাঙালির ঘরে। যারা এসব বই পড়ত তাদের দেখা হতো অন্য নজরে।
এত বাধার পরেও কাজী আনোয়ার হোসেন অবিচলভাবে নিজেকে বাংলা সাহিত্যের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আজও তিনি পাননি কোনো পদক। সৃষ্টিশীল এই মানুষ কাজী আনোয়ার হোসেন, বাংলা সাহিত্যের একমাত্র পাঠক তৈরির কারিগর হিসেবে বোদ্ধা মহলে গণ্য। কেতাবি কোনো পদকের দরকার নেই লাখো পাঠকের হৃদয় জয় করা কাজী আনোয়ার হোসেনের। জয়তু কাজী আনোয়ার হোসেন, জয়তু শামসুদ্দীন নওয়াব।
লেখক : সাংবাদিক