প্রচ্ছদ » » বিস্তারিত
আর্থসামাজিক উন্নয়নে দর্শনায় চাই পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর
২০১৭ জুলাই ২২ ২০:৫৮:৫৬রিফাত রহমান, চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু হলে খুলে যাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নের দরজা। রেলওয়ে ওয়াগনের পাশাপাশি সড়কপথে ট্রাকযোগে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গেদে সীমান্ত। এই পথে পণ্য আমদানি রফতানির মাধ্যমে স্থল শুল্ক স্টেশন দর্শনায় একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু করা যায়। ১২ জুলাই দর্শনায় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান এমন মতামত ব্যক্ত করেন।
দর্শনা পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক দর্শনা পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমান জানান, ‘এরই মধ্যে ভারত তাদের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরের মাত্র ৮০০ মিটার অংশে রাস্তা, বন্দরের টোলঘর নির্মাণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আর বাংলাদেশের সাড়ে ৪ কিলোমিটার শামসুল ইসলাম স্থলবন্দর সড়ক প্রশস্ত করার জন্য ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকার প্রাক্কলন প্রস্তুত করেছে এলজিইডি। দ্রুত যার টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হবে। মূলত এ কাজগুলো দ্রুত শেষ হওয়ার পরেই দর্শনা-গেদে সীমান্ত পথে ট্রাকযোগে পণ্য আমদানি-রফতানি কাজ শুরু হবে’।
স্থল শুল্ক স্টেশন দর্শনায় ১৯৬২ সাল থেকে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কাজ শুরু হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন (নং-০১-আইন/২০১৫/২৫২৬/শুল্ক তাং-০১.০১.২০১৫) মোতাবেক ভারত থেকে রেলপথে দর্শনা শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছগাছড়া, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ টিম্বার, চুনাপাথর, পিয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বলক্লে, কোয়ার্টজ, চাল ভূষি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, পোল্ট্রি ফিড, ফ্লাই অ্যাশ, রেলওয়ে স্লিপার, বিল্ডিং স্টোন, রোড স্টোন, স্যান্ড স্টোন, বিভিন্ন প্রকার ক্লে, গ্রানুলেটেড স্লাগ ও জিপসাম আমদানি এবং সকল প্রকার পণ্য রফতানির অনুমোদন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়মানুযায়ী ৪২টি রেলওয়ে ওয়াগনে এক জাতীয় পণ্য বোঝাই করে একটি র্যাক আকারে পণ্য ভারত থেকে আমদানি করতে হয় (০১টি র্যাক ৪২টি পণ্য বোঝাই ওয়াগন)। এই পদ্ধতিতে ৪২টি ওয়াগণে একই জাতীয় পণ্য বোঝাই করে আমদানি করার মতো ব্যবসায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায় আছে। ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও স্থলপথের যোগাযোগ না থাকায় স্বল্প পরিমাণ পণ্যের আমদানিকারকদের পক্ষে পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয় না। তাই রেলপথের পাশাপাশি সড়কপথের সংযোজন হলে দর্শনা একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মতো অন্যান্য বন্দরের ন্যায় ট্রাকযোগে পণ্য আমদানি-রফতানির সক্ষমতা অর্জন করবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দর্শনা শুল্ক স্টেশন ৬০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬৯ কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার ৩১৮ টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এছাড়াও দেশের ঐতিহ্যবাহী দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানী চিনিকল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি কোষাগারে ৬২ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করেছে। আর রেলওয়ে দর্শনা স্টেশন থেকে আয় করেছে ৪৩ কোটি টাকা।
পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠায় অবকাঠামো সুবিধা : দর্শনা ১৯৯১ সালে পৌরসভায় উন্নীত হয়। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার অন্তর্গত একটি সীমান্ত শহর। এখানে আছে একটি আন্তর্জাতিক রেল স্টেশন, একটি অভ্যন্তরীণ রেল স্টেশন, একটি রেলওয়ে জংশন (বর্তমানে রেলওয়ে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে), একটি ইমিগ্রেশন চেকপোষ্স্ট, চুযাডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যটালিয়নের ৬টি বিওপি ক্যাম্প সম্বলিত একটি কোম্পানি সদর ক্যাম্প, প্লান্ট কোয়ারেনটেইন অফিস, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেডের একটি করে শাখা আছে। আন্তর্জাতিক ডিজিটাল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, বাংলাদেশের বৃহত্তম চিনিকল কেরু এন্ড কোং বাংলাদেশ লিমিটেড, একটি ডিস্ট্রিলারী কারখানা, একটি জৈব সার কারখানা ও একটি স্থায়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পাশেই অবস্থিত কাস্টমসের নিজস্ব ৪৪ বিঘা জায়গার উপর একটি বিশাল কাস্টমস কমপ্লেক্স, যেখান থেকে স্থল শুল্ক স্টেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া কাস্টমস কমপ্লেক্সের পাশেই রয়েছে একটি ডাক বাংলো, চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের একটি অডিটোরিয়াম, বিটিসিএল অফিস, একটি সরকারি কলেজ ও একাধিক আধা-সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : দর্শনা থেকে দৈনিক ৪০টি যাত্রীবাহী কোচ হাইওয়ে রোড দিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং সিলেট যাতায়াত করে এবং রেলপথে ঢাকা, রাজশাহী, সৈয়দপুরে দৈনিক ১০টি ট্রেন যাতায়াত করে। জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট থেকে দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট থেকে ভারতের গেদে এলসি স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার। জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে দৈনিক গড়ে ২০০-৩০০ যাত্রী ভারতে যাতায়াত করেন। যার পাশে বন্দরের প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে সড়ক পথের সংযোজন হলে স্থলবন্দরের মালবাহী ট্রাক যাতায়াতের জন্য ঢাকা দর্শনা হাইওয়ে রোড থেকে জয়নগর চেকপোস্ট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার পাকা রাস্তা বিদ্যমান আছে।
ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা : ভারতীয় কাস্টমস প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে জানা গেছে বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য সমজাতীয় ভারতীয পণ্য মূল্যের চাইতে অনেক কম হওয়ায় ওই সকল পণ্যের চাহিদা ভারতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সড়ক সংযোগ স্থাপিত হলে এ সকল পণ্য দ্রুত ভারতে রফতানি করতে সুবিধা হবে। তারা দৃষ্টান্ত হিসাবে বাংলাদেশি মজুমদার এন্ড কোম্পানির উৎপাদিত রাইস ব্রান্ড অয়েল, প্রাণ কোম্পানির খাদ্য সামগ্রী এবং আর এফ এল কোম্পানির পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিকের তৈরি স্যানেটারি সামগ্রী এবং চেয়ারের মূল্য ভারতীয় সমজাতীয় পণ্য মূল্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় ভারতে বাংলাদেশি উক্ত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবহন টার্মিনাল : স্থলপথে সংযোগের মাধ্যমে ট্রাকযোগে পণ্য আমদানি-রফতানি হলে পরিবহন টার্মিনাল ও বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জয়নগর চেকপোস্টের অদূরে বাংলাদেশ অংশে অধিগ্রহণ করার মতো পর্যাপ্ত জমি আছে। ইতোপুর্বে সরকারিভাবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দর্শনা জয়নগরে প্রস্তাবিত বন্দর টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন ছিল।
এ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সংযোজন : এরই মধ্যে ডিজিটাল হয়েছে স্থল শুল্ক স্টেশন। দর্শনায় এ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড এর কার্যক্রম চালু করার জন্য গত বছরের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড এর উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি দর্শনা শুল্ক স্টেশনে এ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছে।
১৯৬২ সালে নির্মিত কাস্টমস কমপ্লেক্স সমন্বয়ে রেলপথের পাশাপাশি সড়কপথের যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দর্শনা স্থল শুল্ক বন্দর একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপান্তরিত হলে চাহিদা মোতাবেক পণ্য আমদানি-রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের যেকোন বৃহৎ স্থলবন্দরের অর্জিত রাজস্বের চেয়ে অধিক রাজস্ব অর্জন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ইংরেজরা রেলগাড়ি চালু করে। তখন ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশের দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেললাইন হলো বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর দর্শনা হলো বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন। সে আমলে এ রুট দিয়ে রেলগাড়িতে যাত্রী ও মালামাল আসা-যাওয়া শুরু হয়।
দর্শনা পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক দর্শনা পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমান জানান, দর্শনায় রয়েছে ৪৫ বিঘা জায়গার উপর কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের সকল দপ্তর ও আধুনিকমানের কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরি। এগুলো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলও রয়েছে। শতাধিক সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট অফিসের পাশাপাশি রয়েছে একাধিক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। দর্শনায় পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
(দ্য রিপোর্ট/এপি/জুলাই ২২, ২০১৭)