প্রচ্ছদ » » বিস্তারিত
গোলাপ শাহ মাজারে ফায়দা লুটছেন সুবিধাভোগীরা
২০১৪ মার্চ ১৭ ১৭:১৯:২৮
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে অবস্থিত গোলাপ শাহ মাজার। মাজারের ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ না মিললেও মাজারটি ঘিরে সাধারণ মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধার কমতি নেই। আলোচিত এ মাজার ঘিরে যে যেমন পারছেন ফায়দা লুটে নিচ্ছেন।
শনিবার সকাল ১১টা থেকে মাজার এলাকায় কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করেন দ্য রিপোর্টের এ প্রতিবেদক। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো মাজার ঘিরে নানা অসঙ্গতির কথা।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (দক্ষিণ) সম্পত্তি বিভাগ মাজারটি পরিচালনা করে। এখন চলছে সংস্কারের কাজ। বেড়া দিয়ে মাজারের তিন দিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেবল খোলা রয়েছে উত্তরের দিক। সংস্কার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, কাজ শেষ হতে আরও দুই মাস সময় লাগবে।
রাস্তা পেরিয়ে মাজারের সামনে দাঁড়াতেই ছুটে এলেন এক ব্যক্তি। কালো শার্ট, প্যান্ট, বুট পরিহিত। বেঢপ একটা রোদচশমা কপালে তুলে রাখা। লোকটি এসেই এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মামা টাকা দেন, ভেতরে দিয়ে আই।’ প্রতিবেদকের আগ্রহ না দেখে তিনি বলেন, ‘মামা যান, ভেতরে যান।’
নাম জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার নাম লুৎফর রহমান ওরফে কামাল। আমি আওয়ামী লীগ করি। বাবার ভক্ত। মাজারে বাবার সেবা করি।’
কেবল এ তথ্যটুকু দিয়েই সরে যান লুৎফর। খানিক দূরে এক নারী এসে মাজারে টাকা দিতে চাইলে, ‘আমি দিতাছি’ বলে নারীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাজারের দিকে এগিয়ে যান লুৎফর। টাকা দিয়ে নারী চলে যান, এরই ফাঁকে টাকাটা পকেটস্থ করেন লুৎফর।
মাজারের আশপাশে লুৎফরের মতো অনেক লোক সারাদিন ঘুরঘুর করে। কেউ কেউ ব্যস্ততার জন্য মানতের টাকা ফেলতে মাজার পর্যন্ত যান না, কেউ কেউ আবার চলন্ত বাস থেকেই টাকা দেন। এরই সুযোগ নেন ঘুরঘুর করা লোকগুলো, মাজারে ফেলার নাম করে বেশিরভাগ টাকাই তারা পকেটে রাখেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাজারে ভক্তদের ভিড় বাড়তে থাকে। আগতদের বেশির ভাগ নারী। মাজারের সামনে হ্যান্ড মাইকে একজন বিরামহীন ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন- ‘নিজ হাতে মাজারের বক্সে টাকা ফেলুন। কারও কাছে টাকা দেবেন না।’
বাসাবো থেকে এসেছেন বিউটি বেগম। ‘মাজারে কত টাকা দিলেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘মানত আছিল, ওটা পূরণ হইছে, তাই ৫০ টাকা দিছি।’
দীর্ঘক্ষণ ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে মোনাজাত শেষে মাজার থেকে বের হন সিদ্দিকুর রহমান। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। গোলাপশাহর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি টাকা ফেলেছেন মাজারে।
টাকা দিলে মৃত মানুষের কোনো উপকার হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ভক্তির বিষয়, ওলিরা কখনও মরেন না।’
এদিকে সেই লুৎফর চিৎকার করতে থাকেন। এতে রেগে যান মাইকে ঘোষণা দেওয়া পাঞ্জাবি পরা কাচা দাড়িওয়ালা লোকটা। দাড়িওয়ালা লোকটা খিস্তিখেউর করে লুৎফরকে মাজার থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। একটু সরে গিয়ে লুৎফরও সমানে গালিগালাজ করতে থাকেন।
মানুষের আসা-যাওয়ার পথের পাশেই পা বাঁধা একটা মুরগি পড়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর উপহার হিসেবে এক ভক্ত ছাগল দিয়ে যান। হুট করে এক লোক এসে ছাগল ও মুরগি নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। ‘কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গোলাপশাহ বাবার মসজিদে নেওয়া হচ্ছে।’
মাজারে টাকা পয়সা দিয়ে যারা ফিরছিলেন, সবার মাথায় গোলাপজল ছিটিয়ে দোয়া করার নামে টাকা দাবি করছিলেন এক লোক। লোকজনও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে টাকা দিচ্ছেন বাধ্য হয়ে। লোকটার মুখে মেহেদি লাগানো দাড়ি, চোখে চশমা, গায়ে কাবুলি জামা।
জানা গেল, তিনি মাজারের কেউ নন। তার নাম হাজী সাইফুল। গুলিস্তানে ফলের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা বাদ দিয়ে তিনি এখন গোলাপজল ছিটিয়ে ভক্তদের দোয়া করেন।
মাজারের উত্তর দিকের প্রবেশ পথে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজলের ছোট একটি দোকান। দোকানের কিছুটা পেছনে উঁচু বেদি। আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল নিয়ে যে ভক্তরা আসছেন হাজী সাইফুল এগুলো বেদির উপর রাখতে নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের। সাইফুলের ইশারায় সাদা দাড়িওয়ালা, প্যারালাইজড এক লোক বেদি থেকে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল নিয়ে ছোট্ট দোকানেই পৌঁছে দিচ্ছেন। প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে দুটি ছবি তুলতেইে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন সাইফুল।
কিছু নারীকে মাজারের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল। কেউ কেউ হাতে ও গলায় বাঁধার জন্য লাল সুতো বিক্রি করছেন। অভিযোগ আছে, এদের কেউ কেউ তাবিজ-কবজ দিয়ে সরল মানুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পকেট খসিয়ে নেন।
দুপুর ১২টায় হ্যান্ড মাইকে ঘোষণায় আসেন আরেকজন। লাল রং করা দাঁড়ি, দুই হাতে পাথরের অসংখ্য আংটি। সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো কোট পরা। এক ভক্ত এসে চা দিয়ে গেলে পকেট থেকে সুরা ইয়াসিন লেখা একটা পিতলের পাত্র বের করে তাতে চা ঢেলে পান করলেন তিনি।
তিনি জানান, তার নাম মো. সেলিম। তিনি মাজারের একজন খাদেম ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত।
তিনি বলেন, ‘মাজারের আশপাশে আগে অনেক টাউট-বাটপার ছিল। এখন পরিবেশ ভালো।’
মাজারের আশপাশে ঘুরঘুর করা লোকজন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এরা ফুঁ-টু দেয়। মানুষজন খুশি হয়ে যা দেন, এরা তাই নেন।’
মাজার এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত প্রতি মাসে একবার মাজারের (টাকা ফেলা অংশের) গেট খোলা হয়। এক মাসে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা ওঠার নজিরও রয়েছে। একবার তিন মাসের মাথায় টাকা ফেলা অংশের গেট খুলে হিসাব করে দেখা যায়- ভক্তরা মাজারে আট লাখ টাকা দিয়েছেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, চারপাশে টাউট-বাটপাররা লুটেপুটে নেওয়ার পর মাজারের মূল অংশে জমা হওয়া টাকাও তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রশাসন পায় এক ভাগ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পান এক ভাগ, অপর ভাগ জমা হয় মাজারের তহবিলে।
প্রসঙ্গত, গোলাপ শাহ মাজার নিয়ে ঐতিহাসিক কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। মূল অংশে থাকা দুটি কবর কার তা অজানা রয়ে গেছে। নাজির হোসেনের লেখা ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ ও মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইয়ে এ মাজারটির বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া ঢাকার মাজার ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের কবর নিয়ে রচিত মাওলানা হাকিম হাবিবুর রহমান আখুনজাদার ‘আসুদ গানে ঢাকা (ঢাকায় নিদ্রিত মহান ব্যক্তিবর্গ)’ বইয়েও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে কারও কারও মতে, গোলাপ শাহ মাজারের আগে নাম ছিল নিমগাছতলা মাজার।
(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/একে/এইচএসএম/এনআই/মার্চ ১৭, ২০১৪)