প্রচ্ছদ » সাহিত্য » বিস্তারিত
গ্রন্থালোচনা
নন্দ ঘোষের ছন্দ দোষ
২০২৩ ফেব্রুয়ারি ২৭ ১৬:১৭:৫৪মাহবুবা খান দীপান্বিতার ঝঙ্কারময় পদ্য ‘নন্দ ঘোষের ছন্দ দোষ’।শিশুর খেলামেলার অনুষঙ্গ থেকে পদ্যকে উদ্ধারের প্রয়াস এখানেযেমন লক্ষ্যনীয়, তেমনি পূরণ করা হয়েছে ধ্বনিময়তার শর্ত। ‘ননসেন্স রাইম’র আদলে ‘সেন্স’ সঞ্চারের প্রচেষ্টা আছে অধিকাংশছড়ায়।
‘নন্দঘোষ’র শেষ দুই পঙক্তি ‘পার পেয়ে যায় দুষ্টু নেতা কিংবা রাঘব বোয়ালে/নন্দ মরে তার মরমে বিবেকটাকে খোয়ালে’। এটি যেন সমকালিন শিলালিপিতে উৎকীর্ণ শ্লেষ। মধ্যবিত্তের ক্লেশ রয়েছে ‘দোনামোনা’ ছড়ায়। ‘কিন্তু আমার আয় বাড়ে না পাচ্ছি বেতন গোনা/ভাল্লাগে না আর জীবনের কষ্ট দোনামোনা।’ অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে আঘাত হেনেছেন রাজনৈতিক শঠতায়। ‘স্বাধীন খুনি’, ‘জান যায়’ ‘এই ছড়াটা’ ‘ভোট’ সমকালিন ক্ষতাক্ত রাজনীতির প্রতিবিম্ব। ‘ছল-চাতুরি’ তে লিখেছেন,‘হায়রে তোমার পাষাণ হৃদয়, বাপকে করো ঘৃণা/সত্যি বলো- সেদিন তোমার জন্মদিবস কিনা?’ দীপান্বিতার বেড়ে ওঠা মফস্বলে। ভাবনাগুলোও হাওর বিধৌত । ‘হাওর বাঁওড়’ ছড়ায় তার স্পষ্ট। বাদ পড়েনি নাগরিক বিড়ম্বনাও।
‘বর্ষাকালে ঢাকায়’ ফুটে ওঠে সেটি। লিখেছেন ‘ মহানগর জলের শহর শান্তি কোথাও নাই/বর্ষাকালে মফস্বলে তাই পালিয়ে যাই।’ প্রজন্মের ভার্চুয়াল-সর্বনাশ উপজীব্য হয়েছে ‘এই টিনাদের’ ছড়ায়।বলেছেন, ‘মগজ কাটে নেটের পোকা সময় কাটে অস্থিরে/ পরান জুড়ে নেই বিনোদন নেই দু’ ফোঁটা স্বস্তি রে।’ ‘গুগল মামা’য় লিখেছেন, ‘ঘুম কেড়েছে চোখের/সকল শ্রেণির লোকের/হায় রে মামা গুগল/ তোমার প্রেমে আন্ধা এখন অনেক বাড়ির যুগল’। লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ জনপদের এই ছড়াকার ‘গোপন কষ্ট’ ছন্দবদ্ধের ছলে ডুবেছেন মরমিয়ায়ও। লিখেছেন, ‘কিন্তু আমি নাম না-জানা কেউ/ রেলের চাকা বুকেরই ঝমঝম/শূন্যপথে মায়াবতী ঢেউ/ কেউ জানে না সময় কত কম’। তীক্ষè কটাক্ষ তথাকথিত আধুনিকাদের প্রতি। ‘শাড়ি’ ছড়ায় লিখেছেন ‘শাড়িতেই দেখা যায় মায়েদের ছায়া/প্যান্টপরা নারীকুল মায়াহীন কায়া।’
কোভিড-বিপর্যয়ে মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় । পৃথিবীজুড়ে মৃত্যুর মিছিল। সন্ত্রস্ত মানুষ হয়ে পড়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আশ্রয় নিয়েছে তাবিজ-কবচ-পানি পড়ার। ‘পীরবাবা ধীর’ ছড়ার ফ্রেমে বাঁধা পড়েছে সে সময়টি। দীপান্বিতা লিখেছেন, ‘তাবিজেই যদি হতো করোনার নাশ/মমি করে রাখা যেতো পীরদের লাশ।’ অস্থির সময়। বিপর্যস্ত মানবতা। ক্রমেই অনুভুতিহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। চরম সর্বনাশেও কারও প্রাণ কাঁদে না। আত্মকেন্দ্রিক মানুষের ব্যবচ্ছেদ
‘স্বার্থপর-কড়চা‘। লিখেছেন, ‘মাড়ী আর মড়কে/সব যাক নরকে/আমি তবু থাকি হাসি-খুশিও/খুন হয় কেউ কেউ/কুকুরের ঘেউ ঘেউ/মজা করে আঙ্গুল চুষিও’। এভাবেই ৬৪টি ছড়াই স্পর্শ করেছে বিক্ষত মানুষ ও সমাজের দেয়াল। ছড়া যে শুধুই অসংলগ্ন কথামালার বিন্যাস নয়-এমন ধারণাকে মজবুত করে মাহবুবা খান দীপান্বিতার ছড়া। দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন তিনি। ‘নন্দ ঘোষের ছন্দ দোষ’ তার সপ্তম প্রয়াস। বইটি সুখ-পাঠ্য। যদিও পাঠক হোঁচট খেতে পারেন অন্যখানে। ৪৬-৪৭সহ বিভিন্ন পৃষ্ঠায় অভিন্ন কনসেপ্টের ছড়া রয়েছে একাধিক। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ফুয়াদ বিন ইব্রাহিম।
গতবছর বইটি প্রকাশ করেছে ‘সাহিত্যদেশ’। ২শ’ টাকায় কিনলেও ঠকবেন না পাঠক। ‘নন্দ ঘোষের ছন্দ দোষ’র বহুল পাঠ ও পঠন প্রত্যাশা করছি।