প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত
"নাদিম ভাইয়ের জন্য আমার চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছে"
২০২৩ জুন ১৬ ১১:৩১:৫৫আর রাজী-
রাব্বানী ভাই!
হায় রাব্বানী ভাই!
গোলাম রাব্বানী নাদিম ভাইয়ের জন্য আমার চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছে। তাঁর খুনে আমার বিক্ষুব্ধ মনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তার কিছু এখানে বিক্ষিপ্তভাবে লিখছি:
এদেশে মূলত ঢাকা শহরের বাইরে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের ওপরে সব সময় মৃত্যু-খড়্গ ঝুলতে থাকে। এক চিলতে এদিক থেকে ওদিক হলে নেমে আসা বিচিত্র সব নির্যাতন, যার চরম রূপ মৃত্যু।
এই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র ভয়ানকভাবে দুর্নীতি আকীর্ণ। ছোট-বড় শহরগুলোতে প্রায় সকল সরকারি কার্যালয় দুষিত।উপজেলা-জেলা-বিভাগীয় প্রশাসনের প্রায় সবই কমবেশি অনিয়ম-অনাচার আর দুনীর্তিতে লিপ্ত। অন্য দিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বিনীত, অসহিষ্ণু, আগ্রাসী ও আক্রমণপ্রবণ। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে থাকলে তো কথাই নাই- তারা পুতুল নাচের পুতুলের মতোই আঙুলে নাচাতে চান সকল সাংবাদিককে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সব স্থানীয় সাংবাদিকদের নানান প্রলোভন আর আশার কথা শুনিয়ে সাংবাদিকতায় টেনে আনেন জাতীয় সংবাদ-মাধ্যমের নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকরা। তারপর আর তাঁদের কোনো প্রতিশ্রুতিই তাঁরা রক্ষা করেন না। এমন কি, স্থানীয় প্রতিনিধিদের নিত্যদিনের লড়াই-সংগ্রামের কথাও অধিকাংশ শীর্ষ সংবাদ-নির্বাহী শুনতে চান না। বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে পাশে দাঁড়ানোতো দূরের কথা।
এদিকে দিন বদলের আশায় থাকা স্থানীয় সাংবাদিকরা নানান বঞ্চনায় ভুগতে ভুগতে এক সময় হারিয়ে ফেলেন অন্য যে কোনো একটা কিছুকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সামর্থ্য৷ ক্রমশ স্বল্প বা বিনা বেতনের এই সব সাংবাদিকরা এক সময় আত্মমর্যাদার সাথে যেমন আপোষ করতে বাধ্য হন তেমনি কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে জড়িয়ে যান খবর চেপে রাখাসহ অসাংবাদিকীয় নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
এই বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও গোলম রাব্বানী নাদিম ভাইয়ের মতো অতি স্বল্প সংখ্যক সাংবাদিক সাংবাদিকতার আদর্শ আর মর্যাদা রক্ষার জন্য শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়ে যান। আর তাতেই এক একটা জাতীয় সাংবাদ-মাধ্যম জাতীয় পরিচয় নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। খেয়াল করে দেখুন, এর ব্যতিক্রমে গোলাম রাব্বানীদের মতো প্রবঞ্চিত লাঞ্ছিত সাংবাদিকদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জাতীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হতো ঢাকার আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদ মাধ্যমে। অথচ স্থানীয়/আঞ্চলিক সাংবাদিকদের রক্ষা করা, তাদের জীবনমান বজায় রাখার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেন না কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। বরং এই শীর্ষ-নির্বাহীরা জেলা-উপজেলার সাংবাদিকদের বানিয়ে ফেলেন স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের কমিশন এজেন্ট!
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার শীর্ষ নির্বাহীদের সিংহভাগ এতোই নির্লজ্জ আর চশমখোর যে বছরের পর বছর সহকর্মী প্রবঞ্চনার এই জুলুম চোখ বন্ধ করে চালিয়ে যেতে তাঁদের বিবেকে বাধে না। এরই আর এক রূপ দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নিয়োগের বেলায়ও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও একইভাবে নানান প্রলোভন, মিথ্যা আশ্বাস এবং অতিঅবশ্যই অতি স্বল্প বেতনে কিংবা বিনা বেতনে নিয়োজিত করে তাঁরা তাঁদের সহকর্মী প্রবঞ্চকের ভূমিকা জারি রাখেন। আর অন্য পীঠে সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আসা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ ধড়িবাজ সব রাজনৈতিক শিক্ষকদের পাল্লায় পড়ে অল্প বয়সেই জড়িয়ে যান নানান ধান্ধাবাজী আর সুযোগ-সুবিধার গড্ডল প্রবাহে!
এই গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে যদি কেউ বের হয়ে আসতে চেষ্টা করেন, যদি সত্যি সত্যিই কোথাও কোনোভাবে সাহসের পরিচয় দেন তাঁকে বরণ করতে হয় রাব্বানী নাদিম ভাইদের ভাগ্য! সংবাদ-মাধ্যমে কয়েক কলাম ইঞ্চি বা কয়েক মিনিটের কাভারেজ আর দুই একটা মানববন্ধন-বিবৃতির বিনিময়ে তাঁদের আহত-নিহত হওয়ার দায় শোধ করেন আমাদের জাতীয় সাংবাদিক নেতৃত্ব!
খেয়াল করে দেখুন, এদেশের উচ্চ শিক্ষিত সংবাদ-নির্বাহী আর তার দোসর উচ্চ কোটির আমলা-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর শিক্ষিত-বাঙালী আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের উচ্চ শিক্ষার নামে, নীতিনৈতিকতার নামে ঢালাওভাবে চরিত্রহরণ ও হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছেন নিত্যদিন। অথচ এই শিক্ষিত-বাঙালীরা বলেন না যে:
আপনার কেন্দ্রীয় সংবাদপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশের নীতিনৈতিকতা যেখানে ক্ষতবিক্ষত, সর্বাঙ্গ থেকে যেখানে পূঁজ ঝরছে, গণতন্ত্র যেখানে খুন হয়ে গেছে সেখানে সাংবাদিকতার মাছিরা ভন ভন করবেই। আগে সমাজের এই সর্বব্যাপী ক্ষতগুলো সারান, নিজেরা দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার, অন্যয় বন্ধ করুন তাহলেই দেখবেন স্থানীয়/আঞ্চলিক পর্যায়ে ধান্ধাবাজ সাংবাদিকরা দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। তখন সত্যই যারা সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিতে পারবেন তারা ঠিকই তাঁদের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন।
হে আমার শিক্ষিত-বাঙালী, সাংবাদিকতা করার ন্যূনতম পরিবেশ না দিয়ে আপনারা সাংবাদিকতার নীতি-আদর্শের চর্চা আশা করতে পারেন না। এটা ভন্ডামি! মনে রাইখেন, যাদের আপনারা সর্বাত্মকভাবে পিছনে ঠেলছেন তারা আপনাদের অবশ্যই সর্বাত্মকভাবে পিছনে টেনে ধরবেই। সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের রক্তের দাগ আপনাদের হাত থেকেও মুছতে পারবেন না।
লেখক:আর রাজী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। (লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)