প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত
নির্বাচন ও স্বতন্ত্র ত্বত্ত্ব
২০২৪ মার্চ ১৭ ২৩:১৪:১১তামান্না মিনহাজ:দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’। তবে ‘স্বতন্ত্র’ কিন্তু নতুন উদ্ভাবিত কোন শব্দ বা পদ নয়। এর আভিধানিক অর্থ স্বাধীন, মুক্ত, ভিন্ন। তবে এত বছর ধরে শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, গত জাতীয় নির্বাচনে, সেই অর্থের প্রয়োগ পাল্টে গেছে অনেকটাই। এবং এর পর থেকেই পরিবর্তিত অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে কোন একটি ‘দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী’ শব্দগুচ্ছ।
বছরের শুরু থেকেই নির্বাচনের যে ডামাডোল দেশে চলছে তাতে ঘুরেফিরেই বার বার শোনা যাচ্ছে এই শব্দগুলো। জাতীয় নির্বাচন দিয়ে শুরু করে এর প্রয়োগ হয়েছে সদ্য সমাপ্ত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। ৯ মার্চ অনুষ্ঠত ওই নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে চারজনই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়েছেন একটি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল অংশ নিলেও, ভোট বর্জন করে বিএনপিসহ ১৬টি নিবন্ধিত দল। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ছাড় দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য দলের সব বাধার দুয়ার খুলে দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দল মনোনিত প্রার্থী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিপরীতে ঈগল ও ট্রাকসহ বিভিন্ন প্রতীকে স্বতন্ত্র হয়ে লড়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩১৭ জন নেতা-নেত্রী। ফলে অধিকাংশ আসনেই ভোট যুদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের। ফলাফলেও দেখা গেছে সেই প্রভাব। জয় পান রেকর্ড ৬২জন। যাদের মধ্যে ৫৯জনই সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এ অভিজ্ঞতার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল তাদের নেতা-কর্মীদের নতুন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। আসন্ন ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলটি দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষনা দিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ‘সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থী সব মিলিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মনোমালিন্য, কিছু কিছু জায়গায় সহিংস ঘটনা ঘটেছেৃ.প্রতীক ছাড়া গেলে (নির্বাচনে) দলের মনোনিত প্রার্থীর সঙ্গে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিবাদ এড়ানো সহজ হবে।‘ স্বতন্ত্র হিসেবে অন্য দলের সদস্যদের অংশগ্রহণ বাড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের মূল আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ পর্যালোচনায় দেখো গেছে, দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচনের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। ১৯৮৫ সালে উপজেলা ব্যবস্থা চালুর পর এ পরিষদের চতুর্থ নির্বাচনে অর্থাৎ ২০১৪ সালে প্রথম দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। মাত্র দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পুরে আবারো পদ্ধতিগত পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে ক্ষমতাসীন দল।
এ ব্যবস্থায় ফিরতে বা স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আবার আইন সংশোধনের অবশ্যকতা ব্যক্ত করেছিলেন দেশের খ্যাতিমান নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলী। নির্বাচন আয়োজনে সুদীর্ঘ কাল দেশে-বিদেশে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা সাবেক অতিরিক্ত সচিত জেসমিন টুলি বলেন, ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন নিজেদের সুবিধার জন্য পরিবর্তন করে দলীয় প্রতীকের বিষয়টি যুক্ত যেমন করেছিলো, ঠিক তেমনি এবার ফের দলীয় প্রতীক বিহীন করার ঘোষনা দিয়েছে। সরকারী দলের এ ধরনের ঘোষনার কারণেই আবার আইন সংশোধন করতে হচ্ছে। তাঁর মতে, সরকারের আজ্ঞা অনুযায়ী স্বতন্ত্র তত্ত্বে পরিবর্তন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার ধরন সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকী বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন প্রতীকসহ করার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো হয়নি। আওয়ামী লীগও হয়তো এখন বুঝতে পারছে আগের ব্যবস্থাই ভালো ছিল। প্রতীক থাকলে দল থেকে একজনকেই মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক যোগ্য নেতা থাকতে পারেন। কাজেই কয়েকজন দাঁড়ালে তাদের মধ্যে যদি সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসেন তাহলে তা দলের জন্য ভালো এবং স্থানীয় প্রশাসন ও দেশের জন্যও মঙ্গলজনক।‘
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করার পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও একই অবস্থানে অনড় থাকার কথা জানিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
যদিও নেতিবাচক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের পরও অতীতে স্থানীয় নির্বাচনে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে নেতাদের অংশ নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এর আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই নির্বাচনগুলোও দলের পক্ষে থেকে বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তবে তৃণমূল পর্যায়ে সব নেতা দলের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং কেউ কেউ বিজয়ীও হয়েছেন। এবারও একই পথে হাঁটছেন তারা।
বিএনপি নেতাদের দলের বিরুদ্ধে এমন অবস্থান অবশ্য এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও লক্ষ্য করা গেছে। কোন কোন নেতা দল থেকে বের হয়ে অন্য দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যে কারণে এবারও অতীতের বিষয়গুলোরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়।
বিএনপির এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না নেয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এবার মার্কা ছাড়া দলীয় নির্বাচনই হচ্ছে। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, প্রতীক দেয়া হবে না। প্রশাসন-পুলিশ সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবে। এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে বলে আমি মনে করি না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকলে বরং বিএনপি অংশ না নিলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা ছিল। এখন যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি তাতে সে আশংকা নেই। ‘
স্বতন্ত্রদের অংশগ্রহণ সহজ করতে নির্বাচনী আইনেও বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের স্থানীয় ২৫০ ভোটারের স্বাক্ষরসহ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান ছিল। যা এবার তুলে নেওয়া হয়েছে।
তবে একে পুরোপুরি নির্দলীয় নির্বাচন বলার কোন সুযোগ নেই। প্রতীক না থাকলেও দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। এতে ভিন্ন প্রতীকে প্রার্থী থাকলেও ট্যাগ লেগে থাকবে ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী’। ফলে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তি বা এই দলের অথবা অন্য দলের যোগ্য ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ খুব একটা মসৃণ হবে না।
আরেফীন সিদ্দিকী অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখতে আগ্রহী। তিনি মনে করেন স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচনে দলকে ছাড়িয়ে এলাকায় জনপ্রিয়তা- বিচারের মূল নিক্তি হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় পর্যায়ের ভোট অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক হবে বলেই বিশ্বাস তার।
তবে তেমনটি মনে করছেন না বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা না গেলে প্রতীকহীন দলীয় এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে মনে হয় না। প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে।‘ ফলে আইন পরিবর্তন করে করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণ সহজ করা নয়, তিনি স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করার ওপরই বেশি জোর দেন। পরিশেষে বলা বাহুল্য, অধিকাংশ বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দেশি বিদেশি সমালোচনা এড়াতে কৌশলী হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। এতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদগুলোতে প্রার্থীর গানিতিক সংখ্যা বাড়বে। ঠিক তেমনি প্রতিটি উপজেলায় মনোনয়ন যুদ্ধ মুক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ অবারিত হবে। জাতীয় নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপিসহ ১৬ দল এ নির্বাচনে অংশ না নিলে মূলতঃ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি উপজেলাতেও স্থান ভেদে নিজেদের শক্তি ও সামর্থের জানান দেবে। আর এমনটি ঘটলে সংসদ নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনেও ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ ইসির সামনে রয়েই যাবে।
লেখক: নিউজ এডিটর, টিবিএন২৪ টেলিভিশন