প্রচ্ছদ » » বিস্তারিত

রোদে পোড়া শ্রমিক জানে না মে দিবস কি

২০২৪ মে ০১ ১৩:৩৯:১০
রোদে পোড়া শ্রমিক জানে না মে দিবস কি

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বৈশাখের তপ্ত দুপুর। দেশে চলছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তাপপ্রবাহ প্রতিদিন নতুন রেকর্ড করছে। কিন্তু থেমেই নেই জীবন। এ তপ্ত দুপুরে কাজে ঘেমে-নেয়ে একাকার শ্রমিকেরা।

এ কাজের মজুরি দিয়েই চলে তাদের সংসার। ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয়ে যাওয়া কাজ বিরতিহীনভাবে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তাদের অনেকেই মে দিবসের তাৎপর্য জানেন না। শুধু জানেন, তাদের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। আজ বুধবার পহেলা মে; মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পালন করা হয় এ মে দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এরপর থেকে দিনটি মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এ দিনটিকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সরকারি ছুটি থাকে এ দিন। বাংলাদেশেও আজ সরকারি ছুটি।

মহান মে দিবস পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকভাবে সংহতি ও ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার প্রকাশের দিন। মহান মে দিবস পৃথিবীর সব শ্রমজীবী মানুষের এক অমর প্রেরণার উৎস। কিন্তু এখনো তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে পেশীর দাপটে রক্ত পানি করে যে জীবন যোদ্ধা শ্রমিক, যাদের শ্রমে ঘামে গড়ে ওঠে সভ্যতা, আমাদের যাপিত জীবনের আশ্রয়; যে শ্রমিকের হাতে গড়া অট্টালিকা সেই অট্টালিকায় বসে তাদের কথা ভাবার সময় মেলে না কারো। নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে নিরন্তর খেটে যাওয়া মানুষগুলো উপেক্ষিত থাকবে, এটাই যেন তাদের নিয়তি। একই টুকরি, একই শ্রম, একই কষ্ট। তবুও মজুরির বেলায় লিঙ্গভেদ আর বৈষম্য। যা আজও পোড়ায় মানুষের হৃদয়।

মে দিবস প্রতিষ্ঠার ১৩০ বছরেরও বেশি সময় পরে শ্রম মজুরি, কর্মঘণ্টা ও শোভন কর্মের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, কোনো ক্ষেত্রেই তাদের মর্যাদা বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়নি। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ এ দিবসে এখনো তাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন করে আসছে। আমাদের দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা এখনো তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সমকাজে সমমজুরি থেকে তারা অনেকটা বঞ্চিত।

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিগত শতাব্দীর শেষভাগেও আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণি বিরাট আন্দোলন ও জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এ ব্যাপারে স্মরণীয় ১৯৮৪ সালের শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের( স্কপ) ইতিহাস সৃষ্টিকারী শ্রমিক আন্দোলন। স্কপের ডাকে ২৪ ঘণ্টার সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট সারা দেশকে অচল করে দিয়েছিল। তখন সামরিক সরকার বাধ্য হয়েছিল স্কপের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি করতে। এ চুক্তিতে একদিকে শ্রম আইনের যেমন কিছু সংশোধন করা হয়েছিল, এতে নতুন মজুরি কমিশনও গঠন করা হয়েছিল। শ্রমিকদের বোনাসের দাবিরও স্বীকৃতি মিলেছিল। কিন্তু আজ সেই অবস্থা নেই। বিগত দুই দশক দেশে গণতন্ত্র থাকলেও শ্রমিক শ্রেণির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তবে সত্যিকার অর্থে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা এবং শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আদর্শভিত্তিক সৎ নেতৃত্ব এবং সুস্থ ধারার নিয়মতান্ত্রিকতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মালিকদেরও শ্রমিকদের প্রতি আস্থা রাখার ফলে শিল্প বিকাশ ও শ্রমিকদের উন্নয়ন সম্ভব বলেই মত অনেকের। দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস খাতে শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারিত হলেও সর্বক্ষেত্রে তা অনুসৃত হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের অবস্থা আরো নাজুক। বহু প্রতীক্ষার পর দেশে একটি শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে যেখানে কৃষি শ্রমিকরা স্বীকৃতি পেয়েছেন। মহিলা ও পুরুষ গৃহকর্মীদেরও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার নীতিমালা হচ্ছে। এগুলো আশার কথা। তবে এর বাইরেও অধিকার বঞ্চিত রয়ে গেছেন অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকরা। শিল্পক্ষেত্রে সুস্থ অবস্থা তৈরির জন্য ও শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনমানের নিশ্চয়তা দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা- শিল্প মালিক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন যে, সুস্থ শিল্প বিকাশের স্বার্থে শ্রমিকের মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। অন্যতম প্রধান শ্রম খাত গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় নিয়ামক বিদেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রবাসে এবং স্বদেশে ওই শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।