প্রচ্ছদ » বিশেষ সংবাদ » বিস্তারিত

পাল্টে যাওয়া শ্রমিক শ্রেণি: ভাবতে হবে নতুন করে

 

২০২৪ মে ০১ ১৩:৪৪:৪৮
পাল্টে যাওয়া শ্রমিক শ্রেণি: ভাবতে হবে নতুন করে
 

সেলিম খান: প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় নিজের রাজনৈতিক জীবনের প্রত্যক্ষ একটি অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করতে হচ্ছে এই নিবন্ধ। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। কাজ করি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এর জনসংগঠন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সক্রিয় কর্মী হিসেবে। আমার কাজের জায়গা প্রধানত পার্টির শ্রমিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন—টাফ এ।

সিরাজগঞ্জে তখনও শ্রমিকদের যুথবদ্ধ হয়ে কাজ করবার একটি মাত্র জায়গা হচ্ছে ন্যাশনাল জুট মিলস। যা কিনা স্থানীয়ভাবে কওমী জুট মিল নামেই সমধিক পরিচিত। শ্রমিকসংখ্যা স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে হাজার পাঁচেক। যাদের বেশীর ভাগই শ্রেণি বিবেচনায় নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক। কর্মস্থলের আশপাশের আট থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে তাদের গ্রামের বাড়ি। প্রতিদিনই অনেক দূরত্বের এই পথ মাড়িয়ে তাদেরকে আসা—যাওয়া করতে হয় কর্মস্থলে। এদের অনেকেরই কারখানার আট ঘন্টা শ্রম বিক্রির বাইরে রয়েছে নিজের কিংবা বর্গা নেয়া এক আধটু জমিতে কৃষিকাজের মালিকানা। সঙ্গত কারণেই কাজ শেষের সাইরেন বাজবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি যাবার তাগিদ তাদের নিত্য তাড়না।

শ্রেণি চাহিদায় সাংঘাতিক রকমের দোদুল্যমান চিত্তের অধিকারী এসব আধা শ্রমিক আধা কৃষক মানুষগুলোকে নিয়েই স্বপ্ন দেখি রাষ্ট্র পাল্টে দেওয়ার। অনেক সময়েই সংগঠনের কাজের কথা উঠলেই এসব শ্রমিকের অনেকেই বলে বসেন, নিজের জমিতে কিংবা বর্গাতে ধান লাগাতে শ্রমিক ভাড়া করেছেন। সেখানে না গেলে চলবে না। যাইহোক এমনিভাবেই চলতে থাকে সংগঠনের কাজ। এরই মধ্যে চলে আসে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কনভেনশন। ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার মিলনায়তনে। সারা দেশ থেকেই আসছেন টাফের ছাতাতলে সমবেত শ্রমিক ও তাদের প্রতিনিধিরা। যথারীতি আমাকেও আসতে হয় ঢাকায়। বয়সের তুলনায় আমিই সম্ভবত সব থেকে কনিষ্ঠ শ্রমিক প্রতিনিধি। মফস্বলের একজন তরুণ। রাজনীতির তত্বীয় ঋদ্ধতা একেবারেই কম। যা কিছু অভিজ্ঞতা তার বেশীর ভাগই মাঠের। তারপরও রিপোর্ট তো একটা পেশ করতেই হবে। তাই এ ফোর সাইজের এক পৃষ্ঠাজুড়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেই এনেছিলাম। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে সংগঠনের কাজের বিস্তৃতি সম্পর্কে আগে থেকেই অনেকটা ওয়াকিবহাল ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাই শুরুর দিকেই ডাক পড়লো আমার।

মঞ্চে উপবিষ্ট কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কমরেড বদরুদ্দিন উমর, শাহ আতিউল ইসলাম, আনু মুহম্মদসহ পার্টি ও শ্রমিক ফ্রন্ট ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের অন্য নেতৃবৃন্দ। আমি বেশ ভীরু মনেই এগিয়ে গেলাম পোডিয়ামের দিকে। আমার আগে যারা প্রতিবেদন পেশ করেছেন তাদেরগুলো ছিল বেশ ভারী এবং তত্ত্বকথায় ঋদ্ধ। সে তুলনায় আমার প্রতিবেদনতো মাত্র এক পৃষ্ঠার। তাও আবার বেশ আনাড়ি কলমে লেখা। যাই হোক এক পৃষ্ঠার প্রথম দু্ই কি তিন পরতে সংগঠনের কায়িক বিস্তার আর একেবারে শেষ পরতে ছিল আমার একটি জিজ্ঞাসা। আর সেটি ছিল 'আমরা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিদ্যমান দুবৃত্তয়ান রাষ্টকে উপড়ে ফেলে যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করতে চাই, আদর্শ যেই শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য পার্টির লেখা আর বয়ানে জানতে পাই এবং জানানো হয়—সেই শ্রমিককে তো কাজ করতে গিয়ে পাই না।' দু:খজনক হলেও সত্যি যে সেই কনভেনশনে তো বটেই, আজও আমার সাবেক সেই সংগঠনের নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে কিংবা বাংলাদেশের বামপন্থীদের তরফ থেকে আমি সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাইনি। তাই বলে সেই সদুত্তর পাওয়ার খোঁজে প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি আমার। সেই প্রয়াসের কথা জানাতেই নিজের উপরোল্লিখিত বয়ানটুকু পড়তে বাধ্য করতে হলো পাঠককে। যার জন্য অবশ্যই ক্ষমাপ্রার্থী।

যাইহোক, নিরন্তর খোঁজ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎই একদিন প্রথম আলো পত্রিকাতে “প্রিকারিয়েত : সবচেয়ে বিপজ্জনক শ্রেণি” শিরোনামে একটি একটি লেখা চোখে পড়ে আমার। লেখাটির প্রণেতা ফারুক ওয়াসিফ। ফারুক নিজেও রাজনৈতিকভাবে ছিলেন বদরুদ্দিন উমরদের দলের সঙ্গে যুক্ত, যতটা আমার জানা। লেখাটি পড়বার পর আমার প্রশ্নের উত্তর পাবার একটি কিনারা হয় বটে। পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিতে একেবারেই অচেনা অজানা এই প্রপঞ্চটি (প্রিকারিয়েত) সম্পর্কে জানবার আগ্রহ বেড়ে যায় আমার। কেননা সেই উনিশ শ বিরাশি সালে টাফ এর কনভেনশনে উপস্থাপিত আমার যে জিজ্ঞাসা, আসলে আমরা দলের বয়ানে ও রাজনীতিতে যে শ্রমিকের সংজ্ঞায়ন জেনেছি এবং আমাদেরকে জানানো হয়েছে সেটিতো মাঠের রাজনৈতিক কার্যক্রমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরা তো কার্ল মার্কসের সংজ্ঞায়িত সেই ‘প্রলেতারিয়েত’ নয়, যাদের রয়েছে মালিক কতৃর্পক্ষের স্বাক্ষরে দেয়া নির্দিষ্ট একটি পরিচয়পত্র বা সনাক্তকরণে লিখিত শক্ত কাগজের কার্ড, রয়েছে পরের দিন শ্রম দেবার জন্য নূন্যতম খাবার, স্বাস্থ্যসুবিধা, বিনোদনের উন্মাতাল কদর্য ব্যবস্থা, আর গাদাগাদি করে থাকবার মতো একটি সমষ্টিক আবাসন। এদের কাছে শ্রম বিক্রি করবার কারখানাটি আসলে নিজের মালিকানায় থাকা একখন্ড ভূমি আর পরিবারকে আরো ভালো রাখবার জন্য বিকল্প একটি উপায় মাত্র। তাইতো কওমী জুট মিলের শ্রমিককে যখন বলতাম, কাদের ভাই চলেন... মিছিলে যাই... তখন তার বিনীত অনুরোধ... ‘ সেলিম ভাই, আজকে আমারে বাদ দেয়া যায় না। ইরি ক্ষেতে দুইজন শ্রমিক লাগিয়েছি, ওদের সঙ্গে হাত না লাগালে কাজটা শেষ হবে না।’ তখন আমার পার্টি বয়ানে ঋদ্ধ তত্ত্বের খামতিটা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে আমার কাছে। প্রশ্নটা তীরের মতো ছুটে আসে আমার দিকে, আমাকে জানতে বলে, ‘তাহলে বাংলাদেশে যে শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করানো হয়েছে, আমরা জীবন বাজি রেখেছি যে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সেই শ্রমিক কোথায়?

ফারুকের লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার প্রয়াসটা আরও জোরালো হয় আমার মাঝে। যখন ফারুক লেখেন, “সবখানেই নতুন এক শ্রেণি উঠে দাঁড়াচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে প্রিকারিয়েত। গত শতকে যেমন প্রলেতারিয়েত তথা শ্রমিকশ্রেণি ছিল পুঁজিবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের সামনে সারিতে; সহস্রাব্দের পর তাদের জায়গা নিয়েছে প্রিকারিয়েত তথা শহুরে নিম্নবর্গ। আমার কাছে তখন আমার রাজনৈতিক বন্ধু তথা কমরেডদেরকে ফারুকের বর্ণনামতো ‘শহুরে নিম্নবর্গ’ মনে হয়নি। তবে মাত্র ষোল কি সতেরো বছরের এক রাজনৈতিক কমীর্র কাছে তখন কাদের ভাইয়ের মতো কমরেডদেরকে ‘মালিকানা’ বোধে আক্রান্ত মধ্যবিত্ত হয়ে উঠতে প্রয়াসি সাময়িক ‘শ্রমিক’ এর থেকে বেশী কিছু মনে হয়নি। যারা কারখানাতে কাজ করলেও যাদের মন স্বপ্ন বোনে, পরবর্তী প্রজন্ম যেন হয় শিক্ষিত, সরকারের পোষ্য তথা চাকরিজীবী, কিংবা ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়ী, আর তা না হলেও ধারকর্জ আর বাবার জমানো টাকায় পাড়ি জমাবে বিদেশের শ্রমবাজারেও, পাঠাবে প্রবাসি আয় আর এসবেই পুঁজিতন্ত্রের আয়নায় মালিকানাবোধে আক্রান্ত মন প্রতিচ্ছবি দেখবে অনেকটা নিশ্চিন্ত এক মধ্যবিত্ত পারিবারিক কাঠামোর। তাই শেষ বিচারে আমার বিপ্লবী মমন এমনও ধরেই নিয়েছে, ‘এদের দ্বারা আর যাই হোক, শ্রমিকরাজ তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবার নয়।’

আমরা রাজনৈতিক মনে এমন বয়ান জোরালো হয়—যে শ্রমিক শ্রেণি ৮ ঘন্টা শ্রমদিবসের স্বীকৃতির দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ১৮৮৬ সালের পয়লা মে তারিখে। যাদের রক্তে কেনা হয়েছিল আট ঘন্টা শ্রমদিবস। সেই শ্রমিকতো আজকের বাংলাদেশের শ্রমিকেরা নন। নিজের কাছেই প্রশ্নবানে জর্জরিত হই—যে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব হয়েছিল জার সাম্রাজ্য রাশিয়াতে। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে যে শ্রমিকেরা সম্ভব করেছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠাকে। সেই শ্রমিক কী বাংলাদেশের শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পুরোভাগে?

তবে বিরাশি থেকে আজকের দুই হাজার চব্বিশ দীর্ঘ এই চুয়াল্লিশ বছরে পাল্টেছে বিশ্বব্যবস্থা, পুঁজিতন্ত্রে ফিরে গেছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সদৃশ্য আর্থ—রাজনীতির রাষ্ট্রগুলো, পাল্টেছে বাংলাদেশ, পাল্টেছে দেশের আর্থ—রাজনীতি। অবকাঠামোগত উন্নয়নে গ্রামগুলোও আর নেই গ্রামের বৈশিষ্টে। বিশেষ করে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম আর সংগ্রামজাত রাষ্ট্রকাঠামোর কল্যাণে তৈরি হয়েছিল যে উৎকর্ষ মনন। তৈরি হয়েছিল যে মানবিক মানুষ। যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল ‘আমি’ বা ‘আমার’বলে কিছু নেই। যা কিছু সবই ‘আমাদের।

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হয় যে বিশ্বায়ন প্রপঞ্চের, সেই প্রপঞ্চ উসকে দিয়েছে স্বার্থপরতার অর্থনীতিকে। বিভাজিত হয়ে পড়েছে যুথবদ্ধ বৃহৎ পরিসরের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া। পাল্টে গেছে পুঁজিবাদী উৎপাদন—সম্পর্ক। “তথ্যপ্রযুক্তি, মুক্তবাজার অর্থনীতি, নব্য উদারবাদী অর্থব্যবস্থা, পণ্য ও সেবার বিশ্বময় অবাধ চলাচল এবং বাজারজাতকরণের পুঁজিবাদী আয়োজন সত্তরের দশক থেকে দ্রুত বলীয়ান হয়েছে। বর্তমান সময়ের বানিজ্যের ধরণ ষাটের দশকের চেয়ে একেবারে আলাদা। শিল্পোৎপাদনের জন্য ভূমি—শ্রম—মূলধন—সংগঠনের ধ্রুপদী নিয়ম আর মানা প্রয়োজন নেই। সহজ উদাহরণ নাইকি, টমি হিলফিগার, র‌্যাংলার, অ্যাডিডাস ইত্যাদি বহুজাতিকের মূল যে দেশ; সেখানে কোনো কারখানার প্রয়োজন নেই। একটি বা কয়েকটি ঘর নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ এবং কয়েকজন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ থাকলেই চলে। এ হেন কোম্পানির জন্য পোশাক, জুতা বা অন্যান্য সামগ্রী উৎপাদন করে দেবে অন্যান্য দেশ। যেমন বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, হন্ডুরাস, হাইতি, নাইজেরিয়া ইত্যাদি। সোজা কথা, একসময়ের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষুধা কাজে লাগানো সহজ। তাদের দিয়েই, তাদের ভূমি—শ্রম—সংগঠন ব্যবহার করেই আকাশছোঁয়া মুনাফা কামানো সম্ভব। শুধু পুঁজি আর আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেই চলে। এই পদ্ধতির ইংরেজি নাম ‘আউটসোর্সিং। মূল কথা, অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার অর্থনীতি। যে অর্থনীতি খোলনলচে বদলে দিয়েছে চিরাচরিত শ্রমনির্ভর জীবন—জীবিকার। ‘আউটসোর্সিং’ নির্ভর এই অর্থনৈতিক পথপদ্ধতিতে জীবন—জীবিকার খোঁজে হন্যি হয়ে ফিরছে বিশ্বময় এক বেদুইন জাতি। “কাজের সন্ধানে তারা সীমান্ত, সাগর, পর্বত পেরোচ্ছে। ছেলেমেয়েদের শহরে এনে ফেলছে জীবিকার চুম্বক। টাকার টানে বদলে যাচ্ছে মন আর চলনবলন। কিন্তু সেই চুম্বক যত টানে, তত কাছে নেয় না। মেটায় না চাহিদা, পুরায় না স্বপ্ন। স্বদেশে পরবাসী আর পরবাসে ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়া এই তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়ে পরিত্যাগ করেছে অর্থনীতি ——যার মূল নাম পুঁজিবাদ।

প্রিকারিয়েত কারা

ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের বেঁচে থাকবার অন্যতম উপায় হয়ে ওঠা ‘আউটসোসিং’ নির্ভর এই অর্থনীতির শিকার যে শুধু কম উন্নত কিংবা অনুন্নত বিশ্বের মানুষই তা কিন্তু নয়। ধাপ্পাবাজির এই অর্থনীতির শিকার উন্নত বিশ্বের ক্ষমতাবৃত্তের পরিধিতে থাকা অসংখ্য মানুষও। বিশ্বময় বিশাল এই জনগোষ্ঠিই হচ্ছে প্রিকারিয়েত। “যাদের নেই কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজি (অর্থকড়ির টানাটানি ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাহীনতা, যোগাযোগের সক্ষমতা না থাকা, বৃহত্তর বহির্বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকা, সম্পর্কের গণ্ডি সীমিত থাকা) এমন বৈশিষ্টগুলোই এদেরকে প্রিকারিয়েত হতে বাধ্য করছে।”

হেলাল মহিউদ্দীনের বয়ানে, “প্রিকারিয়েত মূলত সাধারণ যুবজনতা। শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদে শ্রমিক ও পেশাজীবীর জীবনে শোষণ থাকলেও নির্দিষ্ট পেশায় নির্দিষ্ট স্থানে বাঁধাধরা জীবনের নিশ্চয়তা ছিল। ভবিষ্যতের রূপরেখা ছিল। এদের বলা হতো প্রলেতারিয়েত। রূপান্তরিত পুঁজিবাদের বাজার অর্থনীতিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাজ—বসবাস ও জীবনধারা আর নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে নেই, নেই চাকরি ও কাজের স্থায়িত্ব। আশা—নিরাশার দোলাচল এদের নিত্যসঙ্গী। অস্থিতিশীলতার জীবনে গতির চাইতে দুর্গতি বেশী। যখন সমাজে হতাশা, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, রাজনীতিতে অমানবিকতা, তখন ভবিষ্যতের ভরসাও নাগালের বাইরে। ইতালিতে পরিচিত দুস্থজনের সাধু প্রিকারিয়েতের নামে সমাজবিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন প্রিকারিয়েত। এরা বিপন্ন আবার বিপজ্জনকও। নতুন পাওয়া শিক্ষা ও ফেসবুক—টুইটার—হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এরা দ্রুত জমায়েত হওয়া শিখছে। অস্থায়ী চাকরি, অনিশ্চিত ভবিষ্যত এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের মধ্যে যে ক্রোধ তৈরি করে, বৈরী সরকারের বিরুদ্ধে সেটাই তারা উগরে দেয়। এরাই অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রিট আন্দোলন করে, তাহরির থেকে তাকসিম স্কয়ারে ঘটায় গণবিদ্রোহ।

বাংলায় প্রিকারিয়েত

আমরা যারা ‘প্রলেতারিয়েত’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। তারা শুরু থেকেই এই শব্দটির বাংলা অর্থ জেনে এসেছি ‘সর্বহারা’। কিন্তু আসলেই কী প্রয়েতারিয়েত শব্দটির বাংলা অর্থ সর্বহারা? কার্ল মার্কসের ‘প্রলেতারিয়েত’ ধারণাটি শিল্পসমাজে মূলত বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত শ্রম বিক্রেতা শ্রেণি হিসেবেই অভিহিত। শিল্পসমাজে কারখানাকে কর্মস্থল ধরে যে বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণিকে কার্ল মার্কস ‘সর্বহারা’ নাম দেন, তারা বস্তুগত অর্থে ততটা সর্বহারা নন। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানায় কোনো শরিকানা নেই বলে ন্যায্য পাওনাটুকু চাইতে না পারার অক্ষমতাই মূলত সর্বহারার লক্ষণ। মজুরির নিয়ন্তা মজুরিদাতা মালিক, তিনিই ঠিক করেন মজুরির পরিমাণ। মজুরিকে সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কের অপরিহার্য অংশ গণ্য না করে নিছক বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করতে পারার ক্ষমতাই পুঁজিবাদের মুল শক্তি। শিল্পসমাজে নিজেদের মজুরির ন্যায্যতা নিশ্চিত করার সক্ষমতা রয়েছে শ্রমিকদের। শুধুই মজুরির ন্যায্যতাই নয়, আবাসন, স্বাস্থ্যসুবিধার মতো অন্যান্য সুবিধা আদায়ে মালিকের সঙ্গে দরকষাকষি তথা বারগেইন করবারও আইনী অধিকার রয়েছে তাদের। কিন্তু আজকের বিশ্বায়নের যুগে ‘আউটসোর্সিং’ নির্ভর অর্থনীতিতে শ্রমিকদের এমনতর অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। বাজার অর্থনীতিতে এই শ্রমবিক্রেতা গোষ্ঠির নিশ্চিত ও স্থায়ী কোন অবস্থান নেই। ন্যায্যতা আদায়ে তাদের নেই কোনো দরকষাকষির সক্ষমতা। সহজেই নিজেদের কর্মস্থল পরিবর্তনে সমর্থ শ্রমজীবী এই গোষ্ঠিকেই বলা হচ্ছে ‘প্রিকারিয়েত’ বা ‘প্রিকারিয়াস প্রলেতারিয়েত’।

ইংরেজি ‘প্রিকারিয়াস’ শব্দের জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ নেই। ভেঙে বললে ‘অনিশ্চিত’, ‘অনির্ভরযোগ্য’, ‘অনিয়ন্ত্রণযোগ্য’, ‘অনিয়মশীল’, ‘অপরিণতিশীল’, ‘অপরিকল্পনাযোগ্য’, ‘এবড়োথেবড়ো’, ‘এলোপাতাড়ি’, ‘এলোমেলো’, ইত্যাদি ভাবের মিশেল বলা যেতে পারে। মূলত জীবিকাদায়ী খাটুনির প্রেক্ষিতেই শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। ইংরেজিতে ‘প্রিকারিয়াস জব’, ‘প্রিকারিয়াস ওয়ার্ক অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার তো নিয়মিতই নজরে আসে। ভারত ও বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে সকালবেলা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে ঝুড়ি, কোদাল কিংবা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ারাদি নিয়ে একদল মানুষ জড়ো হন দিনচুক্তিতে ঠিকা কাজ পাওয়ার জন্য। শ্রম ছাড়া তাঁদের আর কিছুই বিক্রিযোগ্য নয়। কাজ পেলে কোনোভাবে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচেবর্তে থাকা। না পেলে উপোস করা। কাজ পেলেও দিনের মাঝপথে ‘কাজ ভালো হচ্ছে না’ অজুহাতে ঠিকাদারকর্তা কাজ থেকে সরিয়েও দিতে পারেন। এমন বিবেচনায় এসব শ্রমিকদেরকে ‘ভাসমান’ কিংবা ‘পরিযায়ী’ বলা যেতে পারে। কেননা এরা আজ এখানে তো কাল অন্যখানে। আবার প্রাযুক্তিক উন্নয়নে জানা দক্ষতায় কাজ মিলছে না। ছাড়তে হচ্ছে দীর্ঘদিনের পেশা। বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশা বেছে নিতে। এছাড়া আজ কাজ করছেন এক ঠিকাদারের অধীনে তো কাল অন্য ঠিকাদার তাদেরকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে পরিযায়ী এসব দিনমজুরদের পক্ষে সংগঠিত হওয়া সম্ভব হয় না। গঠন করতে পারে না কোনো সংগঠন বা সমিতি। প্রতিনিয়ত অভিবাসনমুখী হওয়ায় এসব শ্রমবিক্রেতাকে ধ্রুপদী অর্থে শ্রমিকও বলা যায় না।

বাংলাদেশে শ্রমজীবী গোষ্ঠির বৈশিষ্ট্যের এমন বদল রাজনৈতিকভাবে পর্যবেক্ষণে না আসলেও সামাজিক চোখে কিন্তু অনেকটাই পরিচিতি ঘটে গেছে এদের। বিশাল অশিক্ষিত এই জনগোষ্ঠির সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির অধিকারী প্রিকারিয়েত তথা শিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের। শিক্ষিত এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে এরা নিজের এলাকায় শ্রম বিক্রি করতে পারছেন না বটে। তাই এই জনগোষ্ঠির অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে। কলেজ—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন ট্যাক্সি বা মোটরসাইকেল রাইডার হিসেবে। করছেন ফুড ডেলিভারির কাজ। কেউ বা কুরিয়ার সার্ভিসের পোস্টম্যান, রেস্তোরাঁর বেয়ারা, দূরযাত্রার বাসের কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার কিংবা কল সেন্টার ও টেলিমার্কেটিং অথবা ফ্রিল্যান্সিং ধরনের সাময়িক পেশায় নিয়োজিত করছেন নিজেদেরকে। জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের বাইরে নিরান্দময়, অপ্রচলিত, অপছন্দের, অর্থহীন ও মনঃসংযোগ—বিবর্জিত ক্লান্তিকর এবং একেঁঘয়ে এসব কাজের নাম দিয়েছেন ‘বুলশিট জবস’ বা বাজে কাজ। গ্রেবার এই ধরণের কাজের বিস্তৃতি বাড়ার মাত্রাকে সামাজিক বিপর্যয়ের আসন্ন কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন, সতর্ক করছেন আমাদেরকে।

ব্রিটিশ সামাজিক অর্থনীতিবিদ গাই স্ট্যান্ডিং সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠা শ্রমজীবী এই জনগোষ্ঠিকে আখ্যায়িত করছেন ‘আ ডেঞ্জারাস ক্লাস’ বা ‘বিপজ্জনক শ্রেণি’ হিসেবে। শুধুই জীবিকার প্রয়োজনে নৈতিক ও মানসিক উত্থান—পতন—চড়াই—উতরাইয়ে বিধ্বস্ত এই শ্রেণির নাম দিয়েছেন ‘দ্য ভালনেরাবল ডিমনস’ বা ‘বিপন্ন দানবকুল’। অন্যদিকে প্রিকারিয়ান বা প্রিকারিয়েতদের ‘মানবসম্পদের জন্য নয়া হুমকি’ হিসেবে দেখছেন ক্রাইনেট মার্কেটিং সলিউশনের শীর্ষ কর্মকর্তা সের্গেই গলুবেভ। মুক্তবাজার অর্থনীতি ক্ষমতাবানদের জন্য উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টি করলেও সামাজিক ন্যায্যতানির্ভর শ্রমব্যবস্থাপনাকে এড়িয়ে চলে। ‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও’, ‘বাকির খাতা শূন্য থাক’; এ ধরনের দর্শন প্রিকারিয়েতদেরকে কাঁচা অর্থ উপার্জনের দৌঁড়ে মাতিয়ে রাখে।

শ্রেণি অবস্থান

আসলে বিশ্বায়নের এই গোলকধাঁধায় পরিবৃত্ত প্রিকারিয়েতদের একক কোনো শ্রেণিতে পরিণত হওয়ার সুযোগই নেই। ভোক্তা হিসেবে প্রিকারিয়েতও গ্লোবাল বা বৈশ্বিক পর্যায়ের ক্রেতা। কিন্তু আয়—উপার্জন ও সর্বহারা বৈশিষ্ট্যে তারা একান্তই লোকাল বা স্থানীয়। আপ্পাদুরাই বৈশ্বিকতা ও স্থানীয়তার এই অসম মিশেলের নাম দিয়েছেন ‘গ্লোবালাইজেশন’। প্রিকারিয়েত বিশ্বায়নের অংশ হওয়ার বদলে গ্লোবালাইজেশনের পাঁকে আটকা পড়ে যাচ্ছে। ‘ম্যাকডোনাল্ড’ ফাস্টফুড চেইন পৃথিবীর অন্যতম বড় প্রিকারিয়েত তৈরির কারখানা, যেখানে স্থায়ী চাকরি বলে কিছু নেই। বিশ্বায়ন ভোক্তামানস তৈরি করলেও ভোগবাদী জীবনযাপনের সামর্থ্য তৈরি করছে না। উল্টো সেই সম্ভাবনাকে সুদূরপরাহত করছে। অস্থায়ী ও অনিশ্চিত শ্রমবাজারের বিস্তৃতি বাড়ছে বৈ কমছে না। এমন শ্রমবাজারে শ্রমবিক্রেতাদেরকে গাই স্ট্যান্ডিং বলছেন, ‘নিউ ডেঞ্জারাস ক্লাস। বললেন, এদের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সবসময়ই পশ্চাদমূখি। তাইতো বর্তমান জীবনযাত্রার প্রতি অসন্তোষ—অতৃপ্তি নিয়েই তাঁদের দিন কাটে। সময়—সময় তারা ফেটে পড়ে বিদ্রোহে।

তবে এমনতর শ্রম বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নে প্রিকারিয়েতদের অসহায় উত্তর হচ্ছে ‘কী করবো ভাই, উপায় নেই। এই ধরণের উপায়হীনতা প্রিকারিয়াতায়নের অন্যতম কারণ বলছেন গাই স্টান্ডিং বলছেন, উপায়হীনতা তাঁদেরকে ‘অ্যাটাভিষ্ট’ (পশ্চাৎপন্থী) ও ‘রোমো’ (যাযাবর) দলভূক্ত হতে বাধ্য করে। তাইতো পশ্চাৎপন্থী, রক্ষণশীল, ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রিকারিয়েত আশ্রয় খোঁজে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের পেছনে। এদের সমর্থনে উত্থাণ ঘটে ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি ও দুতার্তোর মতো জনতুষ্টিবাদি নেতার। তবে প্রিকারিয়েতদের সবাই যে পশ্চাৎপন্থী, রক্ষণশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল তা নয়। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত অংশটি বেছে নেয় কিংবা নেয়ার চেষ্টা করে বিপরীত কোনো পথ। এক্ষেত্রে তাঁরা আমেরিকান সমাজতন্ত্রী নেতা বার্নি স্যান্ডার্স বা ব্রিটেনের জেরেমি করবিনের মতো প্রগতিশীল নেতৃত্বের মধ্যে আশার পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেক সময়ে আবার তারা বিদ্রোহ বিক্ষোভের মাধ্যমেও নিজেদের এমন কি সামাজিক পরিবর্তনের উপায়ও দেখে থাকেন। এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ভবিষ্যতে বিত্তবান ও প্রিকারিয়েতদের মধ্যে এক ধরনের সংঘাতের সম্ভাবনা টের পাওয়া যায়।

প্রিকারিয়েতরা কখনো রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ‘ শ্রেণি’ হয়ে উঠবে কি না সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাববার যথেষ্ট কারণ ও দায় রয়েছে আমাদের দেশের প্রগতিবাদী নেতৃত্বের। বিশেষ করে বাংলাদেশকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজে যারা নিজেদেরকে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত রেখেছেন।

লেখক : সাংবাদিক, মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন রাজনৈতিক কর্মী।