প্রচ্ছদ » » বিস্তারিত
মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি
২০২৪ মে ০১ ১৩:৫২:২৩
মাহবুব আলম: মে দিবস হলো শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক উৎসব। শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম শপথ ও আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। সারা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণিও বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনার সাথে এই দিনটি পালন করেন। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। এমন কী সংবাদপত্রেও এ দিনটিতে বাধ্যতামূলক ছুটি থাকে। মজুরি ও দাসত্বের দিক থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাইতেও নিম্নতর বিপজ্জনক অবস্থায় অবস্থান করা সাংবাদিক কর্মচারীরা এদিন মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ পরিবার পরিজনের সাথে আনন্দে মেতে ওঠে।
মে দিবসের লক্ষ্য হলো পুঁজিবাদের ধ্বংস সাধন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্যদিয়ে এই ধ্বংস সাধন হয়েছিল। তারপর যা হয় তা হলো শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে সর্বপ্রথম সর্বহারার ক্ষমতায়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সেই রুশ বিপ্লবের সাফল্য ৭০ বছরের বেশি ধরে রাখতে পারেনি রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি। ঠিক যেমন করে ফরাসিরা ধরে রাখতে পারেনি ফরাসি বিপ্লবের সাফল্য।
১৯৯১ সালে রুশ বিপ্লবের ফসল সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেই দেশে আবারও পুঁজিবাদের উত্থান ঘটে। পূর্ব ইউরোপসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশেই শ্রমিক শ্রেণি পরাজিত হয় ও পূঁজিবাদের উত্থান ঘটে। অবশ্য সে এক দীর্ঘ চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। আজকের বিষয় মে দিবস ও শ্রমিক শ্রেণি। এই মে দিবসের কালজয়ী আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে ১৬০ বছর আগে, ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে।
মে দিবসের ইতিহাস:
১৮৮৬ সালের পহেলা মে দিনটি ছিল শনিবার। ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে এদিন শিকাগোসহ আমেরিকার প্রায় সকল শহরের শিল্পাঞ্চলে সফল ধর্মঘট হয়। আমেরিকার সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই দিনের ধর্মঘটে ৩ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে শিকাগো শহরের মিছিল অংশ নেন ৮০ হাজার শ্রমিক। স্বতঃস্ফুর্ত ু শান্তিপূর্ণভাবে প্রথমদিনের ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ সফল হয়। পরের দিন ছিল রবিবার , সরকারি ছুটির দিন। ছুটির পর দিন ৩ মে ধর্মঘট আরো ব্যাপকতা লাভ করে। তাতে ভীত সন্ত্রস্ত পুলিশ ও মালিকদের দালালরা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শুরু করে। চক্রান্তের অংশ হিসেবে ৩রা মে শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে।পুলিশের গুলিতে ৬ জনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৪ মে হেমার্কেট স্কয়ারে এক বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশ পণ্ড করতে মালিকদের ভাড়াটিয়া গুণ্ডাবাহিনী বোমা নিক্ষেপ করে। তার সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের গুলি বর্ষণ। পুলিশের গুলিতে তাৎক্ষণিকভাবে ৪ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন অসংখ্য শ্রমিক। এই অবস্থায় শুরু হয় পুলিশের সাথে শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে শিকাগোর হে মার্কেট রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। নিহত হন ৭ পুলিশও। ইতিহাসে এই ঘটনা হে মার্কেট ট্রাজেডি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের পর শ্রমিকরা ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে তারা তাদের আন্দোলন সংগ্রাম আরো জোরদার করে। আন্দোলন সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত সংগ্রামে বিজয় অর্জন করে। এজন্য শ্রমিকদের আরো সংগ্রাম করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে আরো রক্ত। কারণ এই ঘটনার পর শ্রমিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ লাভ করে। সেই সময় আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদপত্র এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে সর্বাত্মক সমর্থন ও মদদ দান করে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে আন্দোলনরত শ্রমিকদের কমিউনিস্ট হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়, ‘প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট কমিউনিস্টদের লাশ দ্বারা সজ্জিত করা হোক।’ শিকাগো ট্রিবিউন ধর্মঘটী শ্রমিকদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানায়। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের খুন করলো যারা তাদের বিচার হলো না। বিচার হলো শ্রমিক নেতাদের। বিচারতো নয় প্রহসন হলো। ৪ শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হলো। ফিশার, এন্জেল ,স্পাইজ ও পার্সলস- শ্রমিক শ্রেণির চার বীর নেতা নির্ভীকচিত্তে ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিলেন।
শিকাগোর শ্রমিকদের এই লড়াই ব্যর্থ হয়নি। তাইতো ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে পহেলা মে কে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পহেলা মে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসে সারা দুনিয়ার সর্বত্র এক আওয়াজ হয় ‘ দুনিয়ার মজদুর এক হও’। তাই আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে মে দিবস অত্যন্ত তাৎপর্য, পূর্ণ ঘটনা।
উল্লেখ্য, শুধু আমেরিকার হে মার্কেট শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়নি। শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সড়ক- মহাসড়ক। এর মধ্যে ফ্রান্সে একদিনে ৫০ জন শ্রমিকের নিহত হওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশে এই বর্বর হত্যাকান্ড হয় ফ্রান্সের ফারমিন্স শহরে।
মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি:
সরকারিভাবে মে দিবসকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও মে দিবসের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্যে বাংলাদেশে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
৮ শ্রমঘন্টার দাবিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী কাউকে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। এমন কী আমাদের দেশের শ্রম আইনেও বলা হয়েছে, কোনো শ্রমিককে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। কিন্তু এটা কেতাবে লেখা আছে।বাস্তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও শিল্প কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীদের নির্বিঘ্নে ৯/১০ এমন কী আরো বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট, হোটেল ও ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকদের অবস্থা ভয়াবহ।
পশ্চিমা বিশ্বে যখন ৮ ঘন্টার শ্রম ঘন্টা কমিয়ে ৫/৬ ঘন্টা করা হয়েছে সেখানে আমাদের দেশে এখনও শ্রমিকদের ১০/১২ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দেশে সরকারি কর্মচারীরা ২ দিনের ছুটি ভোগ করে। সেখানে শ্রমিকদের এটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের শ্রমিকদের সঙ্গে এখনো দাস সুলভ আচরণ করা হয়। বিশেষ করে গার্মেন্ট মালিকরা ভাবে শ্রমিকরা হয় পশু নয়তো যন্ত্র। এদের আবার বিশ্রাম কিসের? আর বিনোদন? পশুর আবার বিনোদন? নির্লজ্জের মত গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের এমন কী মহিলা শ্রমিকদের ১০/১২ ঘন্টা করে খাটাচ্ছে। তাও সরকারের নাকের ডগায়। একই অবস্থা হোটেল , ট্রান্সপোর্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এমন কী সংবাদপত্রেও মালিকরা সাংবাদিক কর্মচারীদের সঙ্গে দাস সুলভ আচরণ করে। শুধু তাই নয় মারধরও করে। অপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।
ক্ষেতমজুরদের অবস্থাও নাজুক। তাদের সারা বছরের কাজের নিশ্চয়তা নেই,নেই ন্যায্য মজুরী। উপরন্তু ক্ষেতমজুরদের ওপর চলে নির্মম শোষণ নির্যাতন। ফলে ক্ষেতমজুরদের বৃহৎ অংশের দু-বেলা দু-মুঠো ভাত জোটে না। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে দিনকে দিন ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে।
এই অবস্থায় মে দিবসের লড়াই সংগ্রামের তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাইতো মে দিবসের উৎসবে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি আনন্দ উৎসবের মধ্যেও তাদের সংগ্রামী চেতনাকে শাণিত করতে সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করে। যে শপথে বলিয়ান হয়ে এদেশের শ্রমিক শ্রেণি তাদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি সমাজবদলের সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে। যে সমাজে শোষণ নির্যাতন থাকবে না, যে সমাজে মালিকের রক্তচক্ষু দেখতে হবে না। বরং শ্রমিকরা তাদের নিজ গরজেই উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিবে। এ জন্য দরকার শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য । সেই ঐক্যের শিক্ষাই হচ্ছে আজকের মে দিবসের শিক্ষা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক