প্রচ্ছদ » মুক্তমত » বিস্তারিত

একটি পশমওয়ালা বিড়াল ও অনলাইন প্রতারণা

২০২৪ নভেম্বর ০৩ ১৭:৩৮:৫৭
একটি পশমওয়ালা বিড়াল ও অনলাইন প্রতারণা

কাওসার আলম: ছেলেটির পিঠ চাপড়ে বিদায় দেওয়ার সময় আমি আর ওর মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। ত্রস্ত পায়ে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলাম। ওর চোখে কি তখন অশ্রু ঝরছিল কিংবা হতাশায় ডুবে গিয়ে ওইখানে দাঁড়িয়ে ছিল? কিংবা নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজেকেই ধিক্কার জানাচ্ছিল?

ওর নাম হাসিব। ষোল সতের বয়সের ওই কিশোর ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় কুমিল্লা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা অভিমুখী একটা বাসে। বাসটি তখন মনে হয় চিটাগং রোড অতিক্রম করেছে। আমি জানালা দিয়ে ঢাকার মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন দেখছিলাম। ঢাকার ঠিকানা ছেড়েছি পাঁচ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু এখনও ঢাকায় ফেরার একটা তাগাদা অনুভব করি। আমি মনে মনে সেই ভাবনায় বুদ ছিলাম। কিন্তু তাতে ছেদ পড়লো ছেলেটির প্রশ্নে, 'আমি কাঁটাবনে কিভাবে যাব?' আমি তার চেহারার দিকে তাকালাম। হালকা গড়নের ছেলেটির মুখে ছোট ছোট কচি দাঁড়ি। তবে এখনও তাতে ক্ষুর লাগায়নি। গায়ে সাধারণ মানের একটা শার্ট পরা। এক নজরে দেখলেই বুঝা যায় এক ধরনের সরলতার আভা তার মুখাবয়ব জুড়ে। আমি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, কাঁটাবনে কেন যাবা? কোন কাজ আছে কিংবা পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা করবে? আমার একগুচ্ছ প্রশ্নে সে জানাল, 'আমি একটি দোকানে যাব। আমি একটি বিড়ালের অর্ডার দিয়েছিলাম। গত শুক্রবার ( ২ নভেম্বর) সেটি ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনভাবে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফোন বন্ধ পাচ্ছি, ম্যাসেজ দিলেও কোন রিপ্লাই দেয় না। কাঁটাবন মার্কেটে একটি দোকানের নম্বর দিয়েছিল। এখন সেই দোকানে গিয়ে দেখবো বিড়ালটি কেন ডেলিভারি হয়নি।'

আমি কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে আবারো তাকালাম তার দিকে। ওর মতো ছেলের বেড়াল কেনার শখ কেন হলো? বাড়িতে বেড়ালের উৎপাতের যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হই। দেশে কি বেড়ালের আকাল পড়েছে যে, বেড়ালও কিনতে হবে? আর পশু-পাখি বা প্রাণী কেনার শখ তো ওর আর্থিক বিবেচনায় এক ধরনের বিলাসিতাই বটে। আমি মনে মনে এসব ভাবছিলাম। সেই বলতে থাকলো, বাড়িতে দেশি বিড়াল আছে। কিন্তু মায়ের শখ একটি বড় পশমওয়ালা বিড়াল পোষার। আমি মায়ের শখ মেটানোর জন্য বড় পশমওয়ালা একটা বিড়ালের অর্ডার অনলাইনে দিয়েছিলাম।

ছেলেটির বাড়ি খুলনার বাগেরহাটের কচুয়া থানায়। থাকে দাউদকান্দি উপজেলার মেঘনা থানায়। সেখানে একটা প্রতিষ্ঠানে দিনভিত্তিক মজুরিতে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে। দৈনিক চারশত টাকা হাজিরা। থাকা খাওয়া মিলে মাসে সাড়ে চার হাজারের মতো খরচ। প্রতি মাসে চৌদ্দ পনের হাজার টাকা আয় তার। মাসিক আর হাত খরচের কিছু টাকা রেখে বাকি টাকা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তার একটি বোন আছে। সে যশোরের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটে লেখাপড়া করে। মূলত বাবার হাত ধরেই দাউদকান্দিতে এসেছে সে। ওই একই প্রতিষ্ঠানে তার বাবাও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে। তার মুজরি দৈনিক ৭০০ টাকা।

বেড়াল প্রসঙ্গে আমার কৌতুহল মেটাতে জানাল, একবার মা একটি বড় পশমওয়ালা একটি বেড়ালের কথা বলেছিল। বেড়াল কিনতে বা এজাতীয় কোন কিছুই মা বলেনি। কিন্তু আমি মায়ের শখ পূরণের জন্য বেড়াল কেনার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেই। মা যদি কোন কিছু চায় কিংবা আমার মনে হয় এই জিনিসটা কিনে দিলে মা খুশি হবে; তাহলে যতক্ষণ তা কিনতে না পারি ততক্ষণ আমার মন শান্ত থাকে না। আমি অস্থির হয়ে উঠি।

আমার গন্তব্য কারওয়ান বাজার। ১২টায় নির্ধারিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা আমার। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে সাড়ে দশটা পেরিয়েছে। যাত্রাবাড়ি বা সায়দাবাদ থেকে কারওয়ান বাজারে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে আমি নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ওকে নিয়ে কাঁটাবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও আমি ততক্ষণে কাটাবন যাওয়ার পথ ওকে বাতলেও দিয়েছিলাম। আমি বললাম, তুমি সায়েদাবাদ আমার সঙ্গে নামো। সে কিছুটা ভয় পেয়েছিল কি না, জানি না। আজকাল সাধুর বেশেই চোর আসে। সে হয়তো আমাকেই সন্দেহ করছিল, এ কার খপ্পড়ে পড়লাম। কিন্তু আমাকে উপেক্ষা করতে পারছিল না। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে আমাকে অনুসরণ করতে থাকলো। দয়াগঞ্জ বাজারে আমার বিশেষ পছন্দের চা কেনার জন্য সায়েদাবাদ থেকে হেঁটেই যচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতেই সে বলে উঠলো, আর কতক্ষণ লাগবে? আমি মজা করে বললাম, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? আমি কি তোমাকে কোথাও নিয়ে টাকা, মানিব্যাগ নিয়ে যাবো, ভাবছো? সে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো কিন্তু নিরবই থাকলো। যা হোক চাপাতা কেনার পর আমি বললাম, আমি তোমার সঙ্গে যাব। এবার মনে হয় সে সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। আমার পাল্লায় পড়ে কি না মুশকিলেই পড়লো! দয়াগঞ্জ থেকে বাসে উঠলাম। বেড়াল ক্রয়ে ম্যাসেঞ্জারে তাদের সেই কথোপকথনের শর্টগুলো দেখালো। পশমওয়ালা যে বেড়ালটি সে অর্ডার করেছিল তার ছবিও দেখালো। মূলত অনলাইনে ওই বিড়ালটির ছবি দেখার পর সে তাতে ক্লিক করে। হাসিব জানায়, পার্সিয়ান ক্যাট ও ডগ হাউস নামে একটি ফেসবুক পেইজ ছিল সেটি।

কিছু সময় পরই ম্যাসেজ আসে সে বিড়ালটি ক্রয়ে আগ্রহী কি না? মায়ের শখ পূরণের বিষয়টি তার মাথায় ছিল। সেও রিপ্লাই দেয়, সে আগ্রহী। পাঁচ হাজার টাকা দাম চাওয়া হয়। পেজ থেকেই কয়েকদফা বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যমে তিন হাজার টাকা দর স্থির হয়। অগ্রিম হিসাবে কিছু টাকা দিতে বললেও সে রাজী হয়নি। সে বেড়াল পাওয়ার পরই পুরো টাকা পরিশোধ করতে চায়। কিন্তু তাদের পীড়াপীড়িতে আর মায়ের শখ পূরণে সে ওদের দেয়া নম্বরে দু দফায় তিন হাজার টাকা দেয়। হাসিব বলে, টাকাটা আমি তখনই দিতাম না। কিন্তু মালিক ও ডেলিভারি ম্যান দুজনই বলছিলেন, ওনারা নামাজ পড়তে যাবেন। যেহেতু নামাজের কথা বলছে সে কারণে আমি বিশ্বাস করেই টাকাটা পাঠিয়ে দেই। কিন্তু তারপর থেকে বিকাশের মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ এবং ডেলিভারি ম্যানের মোবাইলে সে কল ঢুকাতে পারছিল না। ম্যাসেজ পাঠালেও কোন রিপ্লাই নেই। অবশেষে সে নিজেই খোঁজ নিতে মেঘনা থেকে ঢাকায় আসা তার।

আলাপচারিতার মাঝেই কাটাবনে বাস থামল। হাঁটতে হাঁটতে হাসিবকে দেয়া সেই নির্দিষ্ট নম্বরের দোকানে গিয়া দাঁড়ালাম। দোকানের সামনে গিয়ে তো আমাদের চোখ স্থির। দোকানটি পোষা প্রাণীর খাবারসহ আনুসাঙ্গিক বস্তু বিক্রি করে, কোন প্রাণী নয়! হাসিবের প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে আর বাকী নেই। দোকানে থাকা রিপন নামের এক ব্যক্তিকে দোকানের নাম্বার দিয়ে পাঠানো ম্যাসেজে দেখানো হলে তিনি বলেন, আমরা তো কোন পশু পাখি বিক্রই করি না। প্রতারক চক্র এভাবে অনেককেই নানাভাবে ফঁাদে ফেলে টাক হাতিয়ে নেয়। এ ধরনের অনেক ঘটনা অহরহ ঘটছে। তিনি থানায় জিডি করার পরামর্শ দেন।কিন্তু কে যাবে সেই হ্যাপায়?

কিন্তু কষ্টের তিন হাজার টাকা, মায়ের শখ পূরণের আনন্দ মুহূর্তেই শূণ্যে হারিয়ে গেল। তার চোখ দিয়ে কি তখন পানি গড়িয়ে পড়ছিল কি না, জানি না। আমারও গন্তব্যে ফেরার তাড়া। পিঠ চাপড়ে ওকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় উঠলাম......।

রবিবার (৩ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে হাসিব ফোনে জানাল, ডেলিভারি ম্যানের মোবাইলে কল ঢুকেছে। কিন্তু পরিচয় দেয়ার পর লাইন কেটে ব্লক করে দিয়েছে । অন্য এক নাম্বার থেকে ফোন দেয়ার পরও একই ঘটনা ঘটেছে।

অনলাইনে প্রতারণা এখন নিয়মিত হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়তই এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটছে। সঠিক পণ্য না দেয়া, অধিক মূল্য নেয়া, সময়মতো সরবরাহ না করার মতো নানা অভিযোগে সম্ভাবনাময় এ খাতটি ক্রমেই মানুষের আস্থাহীনতায় পড়ছে। আর ভেঙ্গে যাচ্ছে হাসিবদের স্বপ্নগুলো!

লেখক: সাংবাদিক